এ মাসে কলকাতা রায়টের ৭৮তম বার্ষিকী। দীর্ঘ সময় পার হলো। কিন্তু আগস্ট এলে বাংলার আনাচকানাচে ঠিকই মনে পড়ে যায় ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ এবং পরেরবছরের ‘দেশভাগে’র স্মৃতি।
ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে বিপুল রাজনৈতিক গবেষণা ও মতামত লেখা হয়েছে। এর অনেকগুলোয় ঘটনাবলির জন্য অনেকাংশে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু কতটা সঠিক এই দোষারোপ?
নেহরু বনাম জিন্নাহ: ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে
কলকাতা রায়টের সময়টায় সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ইতিহাসের এই সময়ে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কংগ্রেস, লীগ ও ব্রিটিশ প্রভুদের মাঝে দর-কষাকষি চলছিল। তারই অংশ হিসেবে ১৯৪৬-এর মে-জুনে লর্ড পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ব্রিটিশ ‘ক্যাবিনেট মিশন’ কিছু প্রস্তাব নিয়েআসে। তাতে হিন্দুপ্রধান, মুসলমানপ্রধান এবং মিশ্র চরিত্রের প্রদেশগুলো নিয়ে তিন ধরনের স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের কথা ছিল। প্রদেশগুলো ক, খ ও গ চিহ্নিত ওই তিন ধরনের অঞ্চলের যেকোনোটিতে যুক্ত হতো। ‘গ’ অঞ্চল ছিল বাংলা-আসাম নিয়ে। খ ছিল পশ্চিম দিকের মুসলমান অঞ্চলগুলো নিয়ে।
এই তিনটি স্বশাসিত অঞ্চলের সমন্বয়কারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকত কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের বিষয়গুলো। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগপর্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য একটা সরকার ভারত শাসন করবে বলে কথা হয়।
এ সময় নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলে বসেন, কংগ্রেস প্রয়োজনে ‘ক্যাবিনেট মিশন সমঝোতা’কে সংশোধন করে নেবে। এতে মুসলিম লীগ মনে করল, সম্ভাব্য স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস ফেডারেল ব্যবস্থা থেকে সরে যাবে। ‘খ’ ও ‘গ’ জোনে বিভক্ত মুসলমানপ্রধান এলাকাগুলোর স্বায়ত্তশাসন তারা হয়তো রাখবে না। এ সময় জিন্নাহ (১৯৪৬-এর ২৯ জুলাই) এককভাবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ নামের কর্মসূচি দিলেন; অর্থাৎ সংঘাতের উসকানি এল নেহরুর কাছ থেকে, জিন্নাহ তাতে শক্তভাবে সাড়া দিলেন। নেহরু-জিন্নাহর এই পাল্টাপাল্টির সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর সবেমাত্র তিন মাস হয়েছে।
কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি ছিল ময়দানে মুসলমানদের জমায়েত হওয়া এবং দিনব্যাপী হরতাল পালন। তবে কর্মসূচির শিরোনামের মধ্যে একটা উত্তেজক ব্যাপার ছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেটা কলকাতায় সঞ্চারিত হয়ে যায়।
সৈনিক এল, মোতায়েন হলো না
মুসলিম লীগ যদিও ব্রিটিশ শাসক এবং কংগ্রেসের প্রতি ক্ষোভের অংশ হিসেবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি দেয়, বাস্তবে তাদের নেতৃত্ব বিস্তারিত জানায়নি কর্মসূচিতে ঠিক কী করা হবে। তবে কর্মসূচি অস্পষ্ট হলেও কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর উত্তেজনা অস্পষ্ট ছিল না। কর্মসূচি সম্পর্কে লীগ নেতা আবুল হাশিম বলেছিলেন, ব্রিটিশরা বাংলাকে যেভাবে ছেড়ে যেতে চায়, তার বিরুদ্ধে এই কর্মসূচি।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাজিমউদ্দিন ১১ আগস্ট এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন বলতে কী বোঝায়, সেটা মুসলমানরা জানে। আমরা তাদের নেতৃত্ব দিতে পিছপা হব না। আর আমরা কংগ্রেসের মতো অহিংস কোনো নীতির কাছে বন্দী নই।’
নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য হিন্দুনেতাদের সমালোচনার খোরাক হয় ব্যাপকভাবে। তবে উত্তেজনা ছড়াতে তাঁরাও কম করছিলেন না। ১৪ আগস্ট বালিগঞ্জে এক জনসভায় কংগ্রেস নেতারা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডেতে দোকানপাট খোলা রাখতে বলেন হিন্দুদের। একই সভায় একজন শিখ নেতা এ-ও বলেন, ‘যদি দাঙ্গা হয় তাহলে শিখরা কংগ্রেসের পাশে থাকবে। মুসলমানদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।’ এসব তথ্য জানাচ্ছেন খোদ তখনকার ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ফ্রান্সিস টুকের তাঁর গ্রন্থে [Francis Tuker, While memory serves]। তিনি আরও বলছেন: আগস্টের শুরু থেকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা উত্তেজক বক্তব্য রাখছিলেন। এ কারণে রাঁচি, চট্টগ্রাম এবং পার্বতীপুর থেকে বাড়তি সংখ্যায় সৈন্য নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। বিস্ময়কর হলো, এই সৈন্যদের ১৬ আগস্ট সকাল থেকে মোতায়েন করা হয়নি।