আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ, লেখক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘সর্বজন কথা’ পত্রিকার সম্পাদক। সম্প্রতি জুলাই অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
জুলাই অভ্যুত্থানকে কীভাবে দেখেন?
আনু মুহাম্মদ: জুলাই অভ্যুত্থান আপাতদৃষ্টিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা ধারাবাহিকতা। তবে এটা শুধু তা না। সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ যখন আরও বৃদ্ধি পায় সরকারের সহিংস আগ্রাসী ভূমিকার কারণে, তখনই একটা অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতির তৈরি হয়। সেভাবেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটে।
আমরা জানি, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ওই সময় এই আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি সামনে রেখেই আন্দোলন করছিলেন। তারপরও তাঁদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। সে সময় যেভাবে কোটা বাতিল করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেটার মধ্যে একটা চাতুর্য ছিল। সেটা বাতিল হওয়ারই কথা, সেটাই হয়েছে এ বছরের জুনে। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি করে। শুধু কোটা নিয়ে কেন বিশাল বিশাল জমায়েত হলো, সেটা সরকারের উপলব্ধি করার ব্যাপার ছিল। কারণ, দেশের বড় সমস্যা হলো বেকার সমস্যা। আর জনসংখ্যার যে বিন্যাস, সেখানে তরুণদের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। তরুণ তাঁর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন? দেশে অনেক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি কোনো কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি; বরং এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যেগুলো কর্মসংস্থান নষ্ট করে।
আবার পাবলিক সেক্টর, যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার লাখ পদ খালি ছিল। সরকার সেগুলো পূরণ করেনি। কারণ, সরকার শিক্ষা, চিকিৎসা বেসরকারি খাতেই বাড়তে দিতে চায়। আর কর্মসংস্থান যতটা হচ্ছিল তা নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের আওতার বাইরেই থেকে যায়। এর বাইরে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ থাকলেও, কোটার কারণে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এই তিন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হতাশা, অনিশ্চয়তা এর কারণেই ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে যুক্ত হন।
এ ছাড়া জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জুলুমের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। শিক্ষার্থীরা তাঁদেরই সন্তান, তাঁদের কাজ পাওয়ার আন্দোলনে তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রথম থেকেই ছিল।
এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার কথার কারণে ক্ষোভ-ক্রোধ আরও বাড়ে, পরিস্থিতি অস্বাভাবিকতার দিকে চলে যায়। এরপর ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু হলো। সবকিছু মানুষের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল। এই সহ্যসীমা পার হওয়ার কারণেই জনগণ আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হলেন। এককথায় সরকারের ঔদ্ধত্য, অহমিকা, জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, সমস্যা উপলব্ধি না করার প্রবণতা এবং সর্বোপরি ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের ফলাফল হলো এই গণ-অভ্যুত্থান।
অনেকেই এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছেন। আপনার কাছে কী মনে হয়?
আনু মুহাম্মদ: এ রকম চিন্তার একটা বড় কারণ হলো, ১৫ বছর ধরে মানুষ নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেনি। গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার, ধরপাকড়, নির্যাতন ব্যাপক আকার লাভ করেছিল। সরকার দলীয় লোক দিয়ে সব জায়গা দখল করে রেখেছিল। মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষের মধ্যে একটা পরাধীনতার বোধ তৈরি হয়েছিল। এ রকম একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে মানুষের কাছে স্বাধীনতা মনে হচ্ছে। তবে এটা যেভাবে সংঘটিত হয়েছে, তাকে অবশ্যই গণ-অভ্যুত্থান বলতে হবে। বিপ্লব আরও অনেক বড় ব্যাপার।
বিপ্লবের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থাকতে হয়। বিপ্লব মানে মৌলিক একটা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে যখন রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। এখানে কিন্তু সেই ব্যাপারটা ছিল না। এটা কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য থাকলে প্রস্তুতি অন্য রকম থাকত। তবে এই অভ্যুত্থানের মধ্যে বিপ্লবের উপাদান আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে নেতৃত্বের ভূমিকা দেখা গেছে, সেটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে শিক্ষক, শ্রমজীবী মানুষ ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। যেখানে আগে অভিভাবকেরা সন্তানদের ছেড়ে দিতেন না, সেখানে তাঁরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর আক্রমণ মোকাবিলা করে যেভাবে পুরো সমাজ দাঁড়িয়েছিল, সেটাই গণ-অভ্যুত্থান তৈরি করেছে। মূল দাবি এসেছে—এ অবস্থা এভাবে চলতে পারে না। সবার মধ্যে যখন প্রত্যাশা তৈরি হয় আগের অবস্থায় আর ফেরত যাওয়া যাবে না, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের শাসনে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, সেই আকাঙ্ক্ষাটাই হলো বিপ্লবের উপাদান। এখন গণ-অভ্যুত্থানকে কত দূর পর্যন্ত নেওয়া যাবে, সেটা সামনের দিনে আরও স্পষ্ট হবে।