প্রশ্নফাঁসও কিন্তু একটি বড় এজেন্ডা!

যুগান্তর আবু তাহের খান প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫০

বিগত সরকার আমলের শেষদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি আর যে বিষয়গুলো গণমাধ্যমের সুবাদে সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিভিন্ন সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারির ঘটনা। এর মধ্যেও আবার অধিকতর উল্লেখযোগ্য ছিল সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) আওতাধীন বিসিএস ও অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়গুলো। বিষয় হিসাবে এটি কোটা সংস্কারের চেয়ে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র ও সমাজে মেধাকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয়ই পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় ও ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। আর সে কারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এ প্রশ্নও উঠেছিল, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে আর কোটা সংস্কার করে কী লাভ? সে যা হোক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিধি ছাড়িয়ে দেশ এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওতায়। এ অবস্থায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে অন্যান্য আরও অনেক বিষয়ের মতো প্রশ্নফাঁসসংক্রান্ত অভিযোগেরও দ্রুত নিষ্পত্তি করা।


প্রশ্নফাঁসসংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি বৈশিষ্ট্যগতভাবে কোটা সংস্কারের তুলনায় অনেক বেশি জটিল ও বাধাবিঘ্নময়। সত্যি কথা বলতে কী, জেদ, দম্ভ ও সদিচ্ছার ঘাটতি ব্যতীত কোটা সংস্কারের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা বা প্রতিপক্ষই ছিল না, যেমনটি প্রশ্নফাঁসসংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে রয়েছে। শেষোক্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পদে পদে এমনসব কঠিন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো উতরিয়ে শেষ পর্যন্ত এর যৌক্তিক সমাধান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটা বের করতে পারবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম বাধাই হচ্ছে কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তিশালী আমলাতন্ত্র। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নপত্রফাঁসের বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলীসহ যাদের নিয়ে চতুর্দিকে এত হইচই হচ্ছে, তারা তো আসলে শিখণ্ডি মাত্র। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনায় আনা উচিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের, যারা কোনোভাবেই এ কেলেঙ্কারির দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে সেটি সম্ভব হবে কি?



সম্ভব না হওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে এ কারণে, অভিজ্ঞতা বলছে, এক্ষেত্রে কিছু করতে গেলে দায়িত্বশীল পর্যায়ের আমলারা একজোট হয়ে তা প্রতিহত করবেন অথবা নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতার মারপ্যাঁচে ফেলে এটিকে তারা অতি সংগোপনে এমনভাবে ধামাচাপা দেবেন, কস্মিনকালেও আর প্রশ্নপত্রফাঁসের সঙ্গে জড়িত আমলাদের কারও টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেটুকু ফাঁসার তা ওই আবেদ আলীরাই ফাঁসবে এবং এর সঙ্গে ডিবির তেলেসমাতিতে নিরীহ জজ মিয়া যেমন ফেঁসেছিলেন, তেমনি এ ক্ষেত্রেও হয়তো যুক্ত হতে পারেন নতুন কোনো জজ মিয়া, যাতে মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে (আবেদ আলীকে ছাড় দেওয়ার পক্ষে বলা হচ্ছে না)। আর এর ফলে বিষয়টি তখন দাঁড়াবে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জোড়াতালি দিয়ে আপাতত একটি সমাধান দেওয়া হলেও এর স্থায়ী ত্রুটিগুলো থেকেই যাবে এবং ঘটনার স্মৃতিগুলো কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসতেই লুকায়িত কীটপতঙ্গরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিংবা অতি সংগোপনে আবারও ডালপালা মেলতে শুরু করবে।


প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারি নিষ্পত্তির দ্বিতীয় বাধা, পিএসসি ছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে একাধিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রেস (বিজি প্রেস) অন্যতম। তো একাধিক প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট কেলেঙ্কারি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে একের দায় তারা অন্যের ওপর চাপাতে চান এবং এ পরস্পর চাপাচাপির দ্বন্দ্বে মূল অপরাধীদের নীরবে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় বাধা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে বহুমুখী রাজনৈতিক তদবির। বস্তুত এ রাজনৈতিক তদবিরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিকাংশ পরিচালন ব্যর্থতা, যদিও এর নেতিবাচক ফলাফল সর্বাগ্রে তাদেরই (রাজনীতিকদেরই) ভোগ করতে হচ্ছে। তো প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিরাজমান বাধাগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করতে থাকলে নিঃসন্দেহে তা আরও প্রলম্বিত হবে। অতএব সেটি না করে বরং মূল বাধাটিকে অপসারণের চেষ্টায় মনোযোগী হওয়া যেতে পারে এবং সেটি হচ্ছে ঐতিহ্যিক ধারার অভিযোগ অস্বীকারের মানসিকতা।



রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত এদেশের অধিকাংশ রাজনীতিক, আমলা ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা প্রায় কখনোই তাদের ব্যাপারে আনীত কোনো অভিযোগ স্বীকার করতে চান না, তা সেসব অভিযোগের সঙ্গে যত তথ্য-প্রমাণই হাজির করা হোক না কেন। লক্ষণীয়, অতি সম্প্রতি পিএসসির বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁসের নানা সপ্রমাণ অভিযোগ আনার পরও এর চেয়ারম্যান প্রথম পর্যায়ে গতানুগতিক ধারায় এটিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে আসছিলেন এবং তা করতে গিয়ে তিনি এমনও বলেছিলেন, কোন প্রশ্নে পরীক্ষা হবে তা এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু যখন দেখা গেল, আল্লাহ ছাড়া আবেদ আলীসহ আরও অনেকেই তা জানতেন, তখন তিনি তার সুর পালটে খানিকটা নমনীয় করলেও এখনো বলেননি, প্রমাণ পাওয়া গেলে ফাঁসকৃত প্রশ্নসংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বা পরীক্ষাগুলোর ফলাফল বাতিল করা হবে। বরং সময়ক্ষেপণকারী তদন্তের ইঙ্গিত দিয়েই তিনি গোঁ ধরে বসে আছেন। কিন্তু এদেশে তদন্ত মানে যে মূল বিষয় বা অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়া, তা কে না জানে! এবং সবচেয়ে বেশি জানেন তিনি নিজেই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জন-অসন্তোষ সামাল দেওয়ার জন্য পিএসসি সম্প্রতি ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করলেও যে ফাঁসকৃত প্রশ্নে এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটি বাতিলের বিষয়ে পিএসসি কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি।


একটি বেসরকারি টিভি ইতোমধ্যে ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের পরীক্ষা এবং ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাসহ আরও বেশকিছু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি হাজির করেছে এবং তা করার পর ইতোমধ্যে এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পিএসসি বলতে গেলে অনেকটাই নির্বিকার, যদিও ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে এরই মধ্যে মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীরা। তাহলে পিএসসি কর্তৃপক্ষও কি এ ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতোই পরিস্থিতিকে জটিল করতে চাচ্ছেন? কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একটি নিরীহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে প্রথমেই গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করলে পরবর্তী ঘটনাগুলো হয়তো কোনোদিনই ঘটত না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us