দেশের অর্থনৈতিক সংকটে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিদায়ী সরকারের ফেলে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্প পরিসরে রিজার্ভ ফান্ড সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই মুহূর্তে ভঙ্গুর অর্থনীতি চাঙা করতে বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে নতুন যে আইন চূড়ান্ত হয়েছে, তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভের সংকট ও এলসি খোলার সংকট সমাধানসহ বৈদেশিক বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত করবে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, কোনো ব্যক্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই অফশোর ব্যাংকিং ২০২৪ আইন জরুরি ছিল।
বিদেশ থেকেই দেশের ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় হিসাব খোলা যাবে। আবার বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীর পক্ষে তাঁর নিকটাত্মীয় এই হিসাবে সংযুক্ত হতে পারেন। এটাকে সহজ ভাষায় ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং বা অফশোর ব্যাংকিং বলে।
বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং শুরু হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে। ২০১৯ সালে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তেমন একটা সাড়া ফেলেনি তা। এ বছরের ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪ বিলটি পাস হয়। আইনে বলা আছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, বেসরকারি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কগুলোর শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত নেওয়া যাবে। পাশাপাশি অফশোর ব্যাংকের ইউনিট তাদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ও অগ্রিম বা বিনিয়োগ ঋণপত্র ও গ্যারান্টি সুবিধা দেওয়া, বিল ডিসকাউন্টিং, নেগোশিয়েটিং এবং অন্যান্য বৈদেশিক বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট বহিঃলেনদেন সেবা দিতে পারবে। আইনে আরও বলা আছে, অনাবাসী বাংলাদেশি, বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট আমানত ও ঋণ গ্রহণ ও প্রদান করতে পারবে।
খসড়ায় আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধু লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম চালু করা যাবে। দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য কারা যোগ্য: (ক) বিদেশি নাগরিক বা যাঁরা বিদেশে রয়েছেন তাঁদের ব্যবসায়িক সংস্থা বা ফার্ম। (খ) অনাবাসী বাংলাদেশি, যাঁরা বছরে ১৮০ দিন বিদেশে থাকেন। (গ) ইপিজেড, ইজেট ও হাই-টেক পার্কে এ টাইপ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার এন্টারপ্রাইজ। (ঘ) বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক। (ঙ) বাংলাদেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বিদেশি সংস্থা।
এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যাঁরা বিনিয়োগ করবেন, তাঁরা বিদেশি বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবেন, তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবেন। যিনি বিদেশে অবস্থান করছেন, তাঁর পক্ষে দেশে অবস্থানরত নিকটাত্মীয় হিসাবটি পরিচালনা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে দেশে বসবাসরত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রত্যয়নপত্র ও ছবি সংযুক্ত করতে হবে। অনাবাসী ব্যক্তির ক্ষেত্রে কাজের ধরনের প্রত্যয়নপত্র, ওয়ার্ক পারমিট লেটার, বিদেশে অবস্থানের প্রত্যয়নপত্র এবং এনআইডি কার্ড ও ছবি লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত মুদ্রা যেমন ইউএস ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানের মাধ্যমে এই হিসাব খোলা যাবে। হিসাব পরিচালনাকারীর জন্য এই অ্যাকাউন্টে নানাবিধ সুবিধা আছে, যা অন্য হিসাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেমন—বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন (টিআইএন) নম্বর না থাকলে আমানতের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন নম্বর থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। অনুমোদনকৃত অফশোর ব্যাংকিং আাইন, ২০২৪ নীতিমালায় বলা আছে, ‘অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ প্রাপ্তি হবে, তার ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না।
ব্যাংক পরিচালনা করার জন্য কোনো প্রকার সুদ বা চার্জ প্রযোজ্য হবে না। এই লেনদেনে কোনো প্রকার সীমারেখা ধার্য নেই। যেকোনো পরিমাণের অঙ্ক লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে ইপিজেডে কর্মরত যে বিদেশিরা আছেন, তাঁদের অফশোর ব্যাংকিং চলতি হিসাবের মতো ছিল। চলতি হিসাবে সাধারণত কোনো প্রকার মুনাফা দেওয়ার বিধান নেই। অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪-এর বলে এখন হিসাবধারীরা মুনাফা প্রাপ্য হবেন। অফশোর ব্যাংকিংয়ের গোপনীয়তা অনেক বেশি হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে গোপনে শেয়ার কেনা যায় এবং নতুন কেনা শেয়ারের ব্যাপারটি গোপন ও রাখা যায়।
গ্রাহকেরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে এটিএম বুথ, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। দেশে যাঁর নাম সংযুক্তি করে হিসাব খোলা হয়, তাঁর স্বাক্ষরে টাকা ওঠানো যায়। দেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে সমস্ত টাকা নিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই এবং অর্থ রূপান্তর করা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বিদেশি যাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে দেশের উন্নয়নে বা কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, তাঁরাও অফশোর ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে টাকা উত্তোলন, জমা, ফান্ড ট্রান্সফারের কাজ অনায়াসে চালিয়ে যেতে পারবেন।
বিদেশিরা এসে টাকা জমা রাখতে পারবেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় অনুমতি লাগে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় স্বাধীনভাবে অপারেট করা যায়, অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।