প্রথম ধাক্কা, দ্বিতীয় ধাক্কা, অর্থনীতি এখন তৃতীয় ধাক্কার মুখোমুখি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়ে কাজকর্ম শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী, তা দেশের মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট বলে মনে হয় না। তবে ২০২০ সালে ‘কোভিড-১৯’ যে ধাক্কা আমাদের দিয়েছিল, যে বিপদে ফেলেছিল, তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ ওই ধাক্কা আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দেয়। আমাদের ‘স্ট্রাগল’ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হওয়ার। ২০১১-১২ থেকে অবিরাম উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল অর্থনীতিতে। চারদিকে প্রশংসা। রিজার্ভ বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যয়বহুল বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে বড় আকারের মধ্যবিত্ত। এক-দেড় কোটি লোক দেশের বাইরে। মাসে দেড়-দুই বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। সাক্ষরতার হার বাড়ছে। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে।
শিশুমৃত্যুর হার কমছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমছে। অর্থনীতি এবং সামাজিক সূচকগুলো চকচকে। আমরা উড়ছি আকাশে। কেউ ভাবিনি হঠাৎ চীন থেকে এক অজানা-অচেনা ‘ভাইরাস’ এসে আমাদের থামিয়ে দেবে। ঘরে ঘরে আর্তনাদ, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। চিকিৎসা নেই, হাসপাতাল ভর্তি রোগীতে। অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মিল-কারখানা বন্ধ। মানুষে মানুষে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ। উন্নয়ন তো দূরের কথা, ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা।
হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এক বিখ্যাত শিল্পপতি সিঙ্গাপুর, চীন থেকে ডাক্তার এনেও মৃত্যুবরণ করলেন ‘কোভিড-১৯’-এর কাছে। মৃত্যুর আগে বললেন, ‘ডাক্তার, তোমরা আমাকে বাঁচাও। আমি আমার সব সম্পদ তোমাদের লিখে দেব।’ বোঝা যাচ্ছে কী বিপদ গেছে, কী ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। হয়ে পড়েছিলাম তিন-চার দশক আগের উন্নত এক শ্রীলঙ্কার মতো। ভীষণ গর্বের ব্যাপার। না, বিধাতা আমাদের এই অগ্রগতি সহ্য করলেন না। ২০১৮-১৯-এর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হারের প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ টানা সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রেকর্ড আমরা গড়েছিলাম।
করোনা গেল। লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি দিয়ে কোনোমতে অর্থনীতি ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছুটা ‘রিকভারি’ করলাম আমরা। কিন্তু দুই নম্বর মারাত্মক ধাক্কা এবার এল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে। ১৯৭২-৭৫ সালের মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দেড়-দুই গুণ। ডলার রিজার্ভ অর্ধেক। ডলারের দাম ৮৫-৮৬ থেকে এখন ১২০-১২৫ টাকা। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে আমাদের বারোটা বেজে গেল। রপ্তানির হিসাব এখন মেলে না। যত বলেছি, তার চেয়ে অনেক কম আসল রপ্তানি। আমদানি হচ্ছে প্রচুর। এক বছর তো আমদানি হয়ে গেল ৮৫-৯০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলারের পণ্য।
কী আমদানি হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে আমদানি? আসলে হচ্ছে অর্থ পাচার। খুব দুর্নীতি বেড়ে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আয়ের হিসাবও ঠিক নয়। ২০২৩-২৪-এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।