মামুন রশীদ, প্রথিতযশা ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। আর্থিক খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্সের চেয়ারম্যান। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনে। ২৫ বছরের অধিক সময় কাজ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে—দেশে ও বিদেশে। ছিলেন সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় প্রধান নির্বাহী। বাংলাদেশের ব্যাংকিংয়ে অভিনবত্ব ও উৎকর্ষের জন্য পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘করপোরেট এক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ড। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কোন কোন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন বণিক বার্তার সঙ্গে।
নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
মামুন রশীদ: নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। পূরণ করতে হবে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশা। ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্ব দিলেও আরো বেশকিছু চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হবে। কার্যত একদলীয় শাসনে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা খর্ব, অপশাসন-দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ বেকারত্বে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল পরিবর্তন প্রক্রিয়ায়। তাই তাদের অনেক অনেক ক্ষোভ প্রশমন করতে হবে নতুন সরকারকে। বেহাল অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বড় অংকের বিদেশী ঋণের চাপ মোকাবেলা করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদবিষয়ক অস্পষ্টতা থাকায় অভ্যুত্থানে যোগ দেয়া রাজনৈতিক দলগুলো যে দ্রুত নির্বাচন চাইছে, তাও সামলাতে হবে।
১৬ জুলাই আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দুদিন পর থেকে ৫ আগস্ট সরকারের পতন পর্যন্ত ১৯ দিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলেছে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর গুলিতে চার শতাধিক আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। পাল্টা জবাবে বহুসংখ্যক পুলিশের প্রাণ গেছে। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের সরকার পতনের পর ঢাকার প্রায় সব থানা থেকে সরে যায় পুলিশ। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে প্রাণহানি, গ্রেফতার, নির্যাতনে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে জনগণের। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—প্রতিটি হত্যার বিচার হবে। সরকার পতনের পর পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, সামান্য কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। ডাকাত আতঙ্কে ঢাকাসহ সারা দেশে রাতভর সাধারণ মানুষ সড়কে পাহারা দিয়েছে লাঠি হাতে।
দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এ অস্থিরতা নিরসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী কী করতে পারে?
মামুন রশীদ: মূল্যস্ফীতি হ্রাস হতে পারে প্রধান অগ্রাধিকার। এছাড়া দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য বৃদ্ধিও অতি প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করতে হবে। রফতানিকারকদের স্বস্তি দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, পদে পদে নানা হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক খাতে অনেকদিন ধরেই নৈরাজ্য চলছিল। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষক ও উৎপাদকদের মধ্যে স্বস্তি আনয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। উৎপাদনকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে হবে, যাতে পুরোদমে কাজ চালানো যায়। বিশেষ করে কৃষিতে সময়মতো কৃষি উপকরণ; যেমন সেচ উপকরণ, সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দিতে হবে। এছাড়া কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে কৃষি পণ্য ক্রয় করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করতে হবে যাতে, কৃষকরা না ঠকে। সর্বোপরি, সবক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষিপ্রতা বাড়ানো প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ খুবই কষ্টে আছে, তাদের কষ্ট লাঘবে সরকার আশু পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে করণীয় কী বলে মনে করেন?
মামুন রশীদ: পুলিশ ও জনগণের আস্থার সম্পর্ক অনেকটাই ভেঙে গেছে। অতীতে ভুল হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। দায়িত্ব পালন এবং সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে পুলিশ বাহিনী কাজ শুরু করেছে বলে শুনছি। প্রতিদিনই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। জনগণ পুলিশের পাশে থাকলে শিগগির সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুস-দুর্নীতি ও সীমাহীন বলপ্রয়োগ নিয়ে যেসব কথা রয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না হলে এ বাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার কঠিন নয়। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোই সরকারের অগ্রাধিকার বলে এরই মধ্যে বলা হয়েছে। এ কাজে বাহিনীগুলোর আত্মবিশ্বাস ফেরানো হবে অগ্রাধিকার। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় প্রশাসন খুবই উদ্বিগ্ন। তবে কিছু বিষয় অতিরঞ্জিতও হয়েছে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, নতুন সরকার সংবিধান বাতিল করতে পারে। অভ্যুত্থানকারী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলেছে। কিন্তু কীভাবে তা হবে—স্পষ্ট নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় ছাত্রশক্তি নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, তারা সংবিধানের বদল চায়। তা সম্ভব না হলে ব্যাপক সংশোধন করতে চায়। এজন্য গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর তা গণভোটে অনুমোদন করানো হবে। কিন্তু কেমন রাষ্ট্র সংস্কারের সংবিধান হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।