হঠাৎ করেই দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সবার হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেছে। মাসাধিককালের আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগ। দেশে এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, তা কারোরই ধারণায় ছিল না।
এমনকি আমিও ভাবতে পারিনি এই স্বল্পকালীন আন্দোলন শেখ হাসিনাকে কাবু করতে পারবে। পরিচিতজনেরা আন্দোলনের পরিণতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি তাই বলতাম, শেখ হাসিনা এবারও হয়তো পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু প্রমাণিত হলো, সবার সব ধারণা সব সময় সঠিক হয় না। যেমন হয়নি এবার আমার ধারণাও।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যখন জনসম্পৃক্তি বেড়েই চলছিল, তখন অনেকেই শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ওদের ডেকে কথা বলতে, দাবি পূরণ করতে। কিন্তু তিনি তা কানে নেননি; বরং তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ‘ছাত্রলীগ’কে দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমনের কথা বলার পর আন্দোলনের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে। গোটা পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সংঘাত-সংঘর্ষে কয়েক শ মানুষের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ বিনষ্ট হয়। অবশেষে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। খবর অনুযায়ী, তিনি এখন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
চেষ্টা করছেন অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার। শেখ হাসিনার এই পতনের উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আন্দোলনের মুখে একাধিক সরকারের পতন হলেও কোনো সরকারপ্রধান দেশত্যাগ করেননি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলেও তিনি পালিয়ে যাননি। আর ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের চাপে পদত্যাগে বাধ্য হলেও খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যাননি। এমনকি ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সরকার তাঁকে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চাইলেও খালেদা জিয়া সম্মত হননি। তিনি ওই সরকারকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, ‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, বাংলাদেশই আমার একমাত্র ঠিকানা।
বাঁচলে এ দেশেই বাঁচব, মরলে এ দেশেই মরব।’ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশে থেকে মোকাবিলার এই সাহস খালেদা জিয়াকে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নেতায় পরিণত করেছে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তেমন সাহস দেখাতে পারেননি। তিনি গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বীর সেনাপতিরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায় না। শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করতে গিয়ে অসংখ্যবার জেলে গেছেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে আগরতলা মামলার আসামি করে ফাঁসিতে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তিনি পালিয়ে যাননি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ইচ্ছে করলে পালিয়ে যেতে পারতেন। শেখ হাসিনা এত দিন দেশের জন্য তাঁর পিতার মতো বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু বিপদ সমাসন্ন দেখে লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে বোনকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। একজন রাজনৈতিক নেতার এই অন্তর্ধান যে কত বড় গ্লানিকর, তা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই জানেন। হয়তো শেখ হাসিনাও এখন তাঁর কৃতকর্মের কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন।