অর্থনৈতিক নীতি তৈরির প্রাথমিক শর্তই হলো সঠিক তথ্য, যেটা কিনা সরকারের জন্যই সবচেয়ে বেশি দরকারি। আবার আমরা যারা বাইরে থেকে অর্থনীতির দিকে নজর রাখি, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করি, অর্থনীতিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যার খাতিরে আমাদেরও প্রকৃত তথ্যের প্রয়োজন। এছাড়া দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্যও এসব তথ্য-উপাত্তের যথার্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমরা দেখি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক খাতের তথ্য নিয়ে একটা লুকোচুরি চলে। আমাদের তথ্যের গুণগত মান বা কোয়ালিটি অব ডাটা সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন বর্তমান সময়ে আরো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এ জায়গাগুলোয় বড় ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমদিকে আমরা সন্দেহ করতাম যে ব্যাংক খাতের প্রকাশিত তথ্যে সমস্যা আছে, প্রকৃত তথ্য লুকানো হচ্ছে।
যেখানে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের প্রতি সর্বদা মানুষের আস্থা থাকাটা খুব দরকার, সেখানে আমাদের দেশে কী হয়? সবসময়ই ব্যাংক খাতে তথ্য নিয়ে কারচুপি হয়। ব্যাংকগুলো নিজেদের নানা কর্মকাণ্ড, অপকর্ম লুকানোর জন্য নিজেরাই ব্যাংকিং ডাটাগুলো ম্যানিপুলেট করে। তারপর ঘষেমেজে পরিষ্কার করে সুন্দর বানিয়ে সেই (বানোয়াট) তথ্যগুলো জনসম্মুখে পরিবেশন করে।
কোনো কোনো ব্যাংকের হয়তো আয় নেই, নন-পারফর্মিং কিন্তু তারা দেখাচ্ছে যে তারা আয় করবে। সেই আয় ধরে নিয়ে সেটার ওপর ভিত্তি করে মুনাফা দেখায়, ডিভিডেন্ড ডিক্লায়ার করে, ট্যাক্স পেমেন্ট ইত্যাদি দেখায়। প্রকৃতপক্ষে তাদের কিন্তু ওই আয়ই নেই, তাই টাকাটারও অস্তিত্ব নেই। তারা আমানতকারীদের আমানত তহবিল থেকে নিয়ে সেই অর্থ ব্যয় করছে। এভাবে অর্থনীতি আরো ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিংসহ নানা খাতে এ চিত্রগুলোই বার বার উঠে আসছে। যেমন রিজার্ভের ক্ষেত্রে কী ঘটল? আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলল—না, এই রিজার্ভের তথ্য সত্যি নয়। শেষ পর্যন্ত সরকারকেও এটা মেনে নিতে হলো। ফলে আমাদের রিজার্ভ তথ্য সংশোধিত হলো। এখন আমি বলব, বর্তমানে রিজার্ভ তথ্যকে মোটামুটি সঠিক বলা যায়। এখানে হয়তো-বা সঠিক তথ্যটা দেয়া হচ্ছে। অন্ততপক্ষে স্থানবিন্যাস (ট্রান্সপজিশন) ঠিক আছে।
দেশের আর্থিক খাত বেশ ভয়াবহ অবস্থায় আছে। আর তার প্রকৃত চিত্রটা আমরা পাচ্ছি না। যেমন আমাদের যে নন-পারফর্মিং সম্পদের (অ্যাসেট) পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে হয়তো আড়াই গুণ বেশি রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের যা দেখানো হচ্ছে তা হয়তো মোট নন-পারফর্মিং অ্যাসেটের মাত্র ৪০ শতাংশ। ব্যাংকের যে লাভ ও ডিভিড্যান্ড তার সবই অতিরঞ্জিত। এখানে বড় রকমের পার্থক্য আছে এবং সেটা নিরূপণ করতে হবে।
আবার আমরা দেখলাম যে, রফতানি নিয়ে বড় রকমের সমস্যার সৃষ্টি হলো কিন্তু সেখানে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। যা-ই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংককে আমি এ ব্যাপারে সাধুবাদই দেব। কারণ তারা তথ্যকে স্ফীত (ইনফ্লেটেড) অবস্থায় রাখতে দেয়নি। এ জায়গার সত্যিকারের চিত্রটা তারা প্রকাশ করতে দিয়েছে। বিষয়টি ইতিবাচক, কারণ দেরিতে হলেও প্রয়োজনীয় সংশোধন তারা করিয়েছে। তবে এ চিত্র প্রকাশ পাওয়ায় আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? আমরা দেখলাম যেখানে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে (চলতি হিসাবে) উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) দেখানো হয়েছিল, সেখানে মূলত আমরা নেতিবাচক আকারে (নেগেটিভ ফর্ম) চলে এসেছি। অর্থাৎ আমাদের ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’-এর অবস্থা আগের চেয়ে অনেক দুর্বল। এ প্রকৃত চিত্রটা এখন বের হয়ে এসেছে।
অন্যান্য খাতেরও একই অবস্থা। যেমন আমাদের উৎপাদন খাত (প্রডাকশন সেক্টর) নিয়ে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে সেটার সত্যতা নিয়ে আমি নিজেও সন্দিহান। আমাদেরকে চাল, মাছ, লাইভস্টক উৎপাদনের যে তথ্য দেয়া হয় সেসব আদৌ সত্যিকার চিত্র কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান যারা এসব তথ্য তৈরি করে—বিভিন্ন কৃষিবিষয়ক সম্প্রসারিত সেবা (এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন সার্ভিস), তারা তাদের কার্যকলাপকে যথাযথ (পারফেক্ট) দেখানোর জন্য উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এবং কাগজে-কলমে দেখায় যে তারা সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে। যেটা প্রকৃত অর্থে হয়তো করতে পারেনি। সে চিত্র আমরা কিন্তু বাজারের দিকে তাকালেই দেখি। প্রতি বছর বলা হয়, পেঁয়াজ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু দেখা যায় যে আমরা প্রচুর পেঁয়াজ আমদানি করছি। চাল উৎপাদনে দেখানো হয় আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ তো হয়েছিই, পাশাপাশি চালের উদ্বৃত্ত রয়েছে কিন্তু আবার প্রতি বছরই আমরা ১৫-২০ লাখ টন চাল আমদানি করছি। এটি বেশ লক্ষণীয় যে, ব্যাপক উৎপাদন দেখানোর পরও বাজারে জিনিসপত্রের দামও কমছে না, আবার প্রচুর আমদানিও করতে হচ্ছে। কাজেই এ ব্যবধান ডাটার সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।