বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে তিন শ নদী ও রাজমহল পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকায় বাংলা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রায় সব সময় বিদ্রোহ বজায় রেখেছে। সেদিনের ব্রিটিশ আমলেও ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, অনুশীলন সমিতি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং পরবর্তী সময়ে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, নকশাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এসব তার প্রমাণ। ব্রিটিশকে প্রথমত কলকাতা-ছাড়া ও পরে ভারতছাড়া করেছিল মুখ্যত বাঙালিরাই।
বাঙালির বিদ্রোহী মনোভাবের আরও একটি কারণ আছে। বাইরে থেকে যত নিরীহ আর শান্তই মনে হোক, বাঙালির ভেতরে রয়েছে এক জ্বলিত ইস্পাত। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সে তার স্বাক্ষর রেখেছে। এরশাদের পতনের সময় আমি এক বন্ধুকে রসিকতা করে বলেছিলাম, কোনো একনায়কতন্ত্রী শাসনকে বাঙালি ১০ বছরের বেশি সহ্য করতে পারে না। আইয়ুব খানকে ১০ বছরের বেশি সহ্য করেনি। এরশাদকে ৯ বছরের মাথায় বিদায় করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনকে (রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যার দায়ে) ৭ বছরের মধ্যে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে।
১৯৯১ সালে আমরা গণতন্ত্রের যোগ্যতা ছাড়াই গণতন্ত্র পেয়ে যাই। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। দেশের প্রধান দুটি দল পালাক্রমে অতীতের একনায়কতন্ত্রীদের ধারায়, নিখাদ স্বৈরাচারীদের মতো, দেশ শাসন শুরু করে। ফলে সেই উদগ্র ক্ষমতালিপ্সার মুখে গণতন্ত্রের মহান স্বপ্ন উল্টে ‘রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’তে পরিণত হয়। পরিস্থিতির ক্রমাবনতির মুখে বাংলাদেশ প্রায় দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে যায় ও দেশ গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থায় এসে পড়ে।
সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকারের পর ২০০৮ সালে বর্তমান সরকার বিপুল ভোটে জয়লাভ করলে দেশবাসীর দ্বারা ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হয়। কিন্তু এরপরই তাদের ভেতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা দিতে শুরু করে। বছর দশেক আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারপ্রধানের শিক্ষক ও অতি নিকটজন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক স্বপ্ন অর্জিত হয়নি।’ খুব সম্ভব সে সময় দেশে অব্যাহত দুর্নীতির চক্রবৃদ্ধি দেখে গভীর দুঃখ থেকেই তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। শুধু একালে নয়, বাঙালির নৈতিকতার খুব একটা সুনাম কোনো সময়েই ছিল না। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরের জীবনীতে, ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে, ব্রিটিশ লেখক ও অফিসারদের রচনায় বা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই অনৈতিকতার হাজারো চিত্র আমরা অহরহ পাই। যে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের নৈতিক মান এমন প্রশ্নবিদ্ধ, সে দেশের কোনো দলীয় সরকারের নেতৃত্বে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ভাবাও কঠিন।
এ কারণে ১৯৯১-এর নির্বাচনের সময় থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই ঐকমত্যে আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার একমাত্র নিশ্চয়তা মনে করায় ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে তৎকালীন সরকারের দ্বারা পদ্ধতিটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেন।
যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন করেছিলেন, তিনিই স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের হাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
এতে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হয় যে চাইলে ক্ষমতাসীন সরকার কারচুপির মাধ্যমে প্রতিটি নির্বাচনে জিততে ও যত দিন খুশি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সুযোগ নিতে পারবে। হলোও তাই। একের পর এক অবিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বর্তমান সরকার নির্বিঘ্নে একচ্ছত্র ক্ষমতায় দেশ শাসন করে চলল। অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ একদিক থেকে গভীর স্বস্তির ব্যাপার হলেও আরেক দিক থেকে খুবই বিপজ্জনক। অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি। তাই এই ক্ষমতা যেন চিরস্থায়ী হয়, এমনই একটা দুরপনেয় আকাঙ্ক্ষা, শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ-এর মতো, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের হৃদয়কে লুব্ধ করে তুলতে থাকে। হয়েছেও তা-ই। ধীরে ধীরে, নিপুণ কৌশলে, বিপুল জবাবদিহিহীন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকে (সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও অনেকাংশে বিচার বিভাগকে) তারা সম্পূর্ণভাবে বশীভূত করে ফেলেছে। দলের লাখ লাখ কর্মীকে নির্বিচার সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, ছিনতাই—এসবের সুযোগ দিয়ে দেশকে অপ্রতিহত লুণ্ঠনের সাম্রাজ্য করে ফেলা হয়েছে।