হঠাৎ করেই দেশটার যেন এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আগে থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। রাজনীতিতে সংঘাতময় বিভেদ-বিসংবাদ তো পুরোনো বিষয়। অর্থনীতিতে টানাপোড়েনও দু-তিন বছর ধরে চলছে এবং তা ক্রমাগতভাবে ঘনীভূত হয়েছে। আইনের শাসনের শৈথিল্য এবং সরকারি নজরদারির দুর্বলতার সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে সর্বব্যাপী দুর্নীতি। খেলাপি ঋণের নামে ফতুর করে দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। বিদেশে অর্থ পাচার দেশের মেরুদণ্ড বাঁকা করে ফেলেছে।
এই সব অনাচারই চলেছে প্রতিকারহীন ও অব্যাহতভাবে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসীম হতাশা ও ক্ষোভ। এত কিছু সত্ত্বেও অনেক রকম জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা সরকার করে যাচ্ছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক একটি ছাত্র আন্দোলন রাজনীতির গতিপথ এবং দেশের যাত্রাপথ পাল্টে দিয়েছে। সে পথের শেষ যে কোথায় এবং সে পথের শেষে কী আছে, তার কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত অনুমানযোগ্যও নয়।
তবে নিজ নিজ দলের অবস্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো নিঃসন্দেহে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে দুটি নতুন দৃশ্যপট জনসমক্ষে প্রকট হয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আপাতনির্বিরোধী একটি ছাত্র আন্দোলনের ভয়ংকরভাবে নৃশংস ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং ভবিষ্যতে নতুন মেরুকরণও সৃষ্টি করবে। এই পটভূমিতে দেশে রাজনীতির গতিপথ কোন অভিমুখে ধাবিত হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের ভয়ংকর নৃশংস ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠার জন্য সরকার ও সরকারি দলের দায় আছে বলে মনে করা হয়। কারণ এই ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। হলে পরিস্থিতি অবশ্যই অন্য রকম হতে পারত। এর পরের কথা হলো, সরকারি দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগকে আন্দোলনরত ছাত্রদের প্রতিপক্ষ করে রাস্তায় নামানো। মূলত এ কারণেই আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সুযোগ পেয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং সরকারের পক্ষের লোকদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে, এসব কাজের পদ্ধতির মধ্যে। যেমন কাউকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা জঙ্গিদের একটি ‘ট্রেডমার্ক সিম্বল’। এটা আফগানিস্তানে দেখা যায়। অতীতে বাংলা ভাইয়েরা এটা করেছেন। এখন আবার দেখা যাচ্ছে। কোনো অবকাঠামো পোড়ানো বা তছনছ করার ক্ষেত্রেও জঙ্গিদের আলাদা স্টাইল আছে, যা এবারের ঘটনাবলিতেও দেখা গেছে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই, মানে সরকার, বিরোধী দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সবাই বলছি যে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়। সাধারণভাবে কথাটি সঠিক হতে পারে। কিন্তু মাঠে যখন ছাত্রলীগ প্রবেশ করল, তখন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোষ্ঠীর সঙ্গে বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, আন্দোলনরত অনেক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল। গণমাধ্যমকর্মীরা কাছে থেকে তা দেখেছেন। হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিসিটিভি ফুটেজগুলোয় তার প্রমাণ পাবে।
তা ছাড়া আন্দোলনরত সবাই কি সাধারণ শিক্ষার্থী? বিশেষ করে যাঁরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন? তাঁদের কি অতীত কিংবা বর্তমান কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই? গণমাধ্যমে তাঁদের যে পরিচয় বেরিয়েছে, সে অনুযায়ী তাঁরা তো প্রায় সবাই নুরুল হক নুরের অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন সারির নেতা ছিলেন। পরে অবশ্য তাঁরা দ্বিধাবিভক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যখন একত্রে ছিলেন, তখন যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ পেতেন, সে কথা তো তাঁদের দলের শীর্ষ নেতারাই দ্বিধাবিভক্তির পর প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া এখনো তাঁরা প্রত্যেকে দ্বিধাবিভক্ত অধিকার আন্দোলনের একাংশের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের প্রথম সারির নেতা।