সার্বিক কৃষি খাতের (শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বন-এ তিন উপখাত নিয়ে সার্বিক কৃষি খাত) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপখাত শস্য। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের দায়িত্ব শস্য উপখাতের। কিন্তু শস্য উপখাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না। প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এলেও এখনো পণ্যটিতে স্বনির্ভরতা আসেনি। দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমে আমরা প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছি। অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি এবং এগুলোর চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মেটাতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। কেন এ অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এসব আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দেশে চাল, গম, ভুট্টা ও অন্যান্য শস্যজাতীয় খাদ্যলভ্যতার মূল উৎস হলো শস্য উপখাত। শস্যজাতীয় খাদ্যপণ্যের উচ্চ প্রবৃদ্ধিহার খাদ্যশস্যের আমদানির প্রয়োজনীয়তা নিরসন বা হ্রাস করে অর্থনীতিতে অবদান রাখে। অন্যদিকে শস্যজাতীয় খাদ্যপণ্যের নিম্ন প্রবৃদ্ধি হার দেশকে এসব পণ্যে আমদানিনির্ভর করে তোলে। শস্য উপখাতের প্রধান ফসল ধান তথা চাল। এটা সত্য, চাল উৎপাদনে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছি। স্বাধীনতার সময়কালের কম-বেশি ১ কোটি টন চালের উৎপাদন বর্তমানে সাড়ে ৩ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত পণ্যটিতে স্বনির্ভরতা আসেনি। এর প্রধান কারণ চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’-২০২৩-এর তথ্য মোতাবেক, ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার (আরএনআই) ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আগের বছর (২০২২) ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ২০২১ সালে এ হার দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত ৩ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিহার ছিল ১ শতাংশের নিচে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় দেশের চাহিদা মেটাতে পণ্যটি আমদানির বিকল্প নেই। আমাদের প্রতিবছর কিছু পরিমাণ চাল আমদানি করতে হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বিশ্বে চাল আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাল আমদানিতে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে যথাক্রমে ৮৫১, ৪২৭ ও ৫৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪)।
আমাদের খাদ্যশস্যের তালিকায় চালের পরের অবস্থানে অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০২২ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক গমের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৯ গ্রামে। ২০০৫ সালের হায়েসে এর পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ১ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা ছিল ১৯ দশমিক ৮ গ্রাম। এ থেকে বোঝা যায় গমের ব্যবহার কীভাবে বাড়ছে। গমের ব্যবহার বাড়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. জনসংখ্যা বৃদ্ধি : জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী, স্বাধীনতার সময়ের সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটিতে। দুই. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসচেতনতা : সময়, আয় ও জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের দোলা খাদ্যাভ্যাসেও লেগেছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত-সব শ্রেণির ভোক্তার খাদ্য তালিকায় গম তথা আটা-ময়দা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে আয়ের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। তিন. গমের আটা-ময়দা থেকে তৈরি বিস্কুট, কেক, ইত্যাদি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং রপ্তানি হচ্ছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়।
বর্তমানে দেশে বছরে গমের চাহিদা কম-বেশি ৭৫ লাখ টন। আর এ চাহিদার বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গমের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে, যদিও ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন। ফলে গমের চাহিদার ৮৫ শতাংশ মেটাতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। সরকারি হিসাবে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৮৩০, ২ হাজার ১৩৫ এবং ২ হাজার ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪)। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ১৯ লাখ টনের বেশি গম উৎপাদিত হওয়ায় ওই অর্থবছরে গম আমদানি বাবদ ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৩২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০০)।