শিশু পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি

বণিক বার্তা সিকদার মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২৪, ১১:২১

প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তাদের অনেকেরই এ যাত্রার শেষ পরিণতি হয় মানব পাচারের শিকার হয়ে। বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল সংঘবদ্ধ অপরাধগুলোর মধ্যে মানব পাচার অন্যতম। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশেও মানব পাচারের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছে ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। এদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৫১৯ নারী অভিবাসী কর্মী যাদের ৬৬ শতাংশ সৌদি আরবে ও ১০ শতাংশ জর্ডানে ও ৯ শতাংশ ওমানে গেছেন।  ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘মানব পাচার রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, সরকারের পাচারের ভিক্টিম শনাক্তকরণ হিসাবে দেশে ১ হাজার ২১০ জন পাচারের শিকার, যার মধ্যে ২১০ জন যৌন, ৭৯৫ জন জোরপূর্বক শ্রম ও ২০৫ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। একই সময়ে এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, কমপক্ষে ১০ হাজার ১৩৫ ভিক্টিমকে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের মধ্যে ১ হাজার ৭৮৪ জন যৌন পাচার, ৮ হাজার ৯০৯ জন শ্রম পাচার এবং ২৬১ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। সরকারি ও বেসরকারি দুটি রিপোর্টেই ২০২৩-এর তুলনায় এ বছর মানব পাচারের ভিক্টিমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।


মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা যার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রতি বছর ৩০ জুলাই দিনটিকে বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশেও এই দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও উল্লেখযোগ্য হারে মানব পাচারের শিকার হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানব পাচারের শিকার প্রতি তিনজনের মধ্যে একটি শিশু। শিশু পাচারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় নেয়া হয়েছে, ‘Leave No Child Behind in the Fight Against Human Trafficking’ । দিবসটি উদযাপন করতে জাতিসংঘের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, বিশ্বব্যাপী মানব পাচারের শিকারের মধ্যে ২৭ শতাংশ শিশু, এবং প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটিই মেয়ে। শিশু পাচার বলতে জোরপূর্বক শ্রম এবং যৌন শোষণের উদ্দেশ্যে মেয়ে এবং ছেলেদের শোষণ করাকে বোঝায়।


বাংলাদেশে অভিবাসনের পেছনে অন্যতম কারণ ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনধারণ। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যে কোনোভাবে বিদেশ যেতে পারলেই পরিবারের সব চাহিদা পূরণের পাশাপাশি একটি নিরাপদ ও সুন্দর জীবন লাভ সম্ভব। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতে, দেশে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং ৫ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ বেকার। এছাড়া নিরক্ষরতা, লিঙ্গ বৈষম্যে, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা, যৌন শোষিত নারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যৌতুক, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণে নারী ও শিশুরা বিদেশে পাড়ি জমাতে আগ্রহী হচ্ছে। বৈধভাবে বিদেশ যেতে হইলে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হয়। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার ব্যাকুলতায় শিশুরা জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে পাসপোর্ট করছে। এতে যখন তারা নির্যাতিত হয়ে বা জোরপূর্বক শ্রম শোষণের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসছে তখন তারা এই অতিরিক্ত বয়সের জন্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পাচারকারীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লোভনীয় অফার, বিশেষ করে উচ্চ বেতনে পরিশ্রমহীন চাকরি, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, মনোরম কাজের পরিবেশ ইত্যাদির কথা বলে তাদের এ ফাঁদে ফেলছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিনা খরচে বা স্বল্প পরিশ্রমে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা ও প্ররোচক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে শিশুদের আকৃষ্ট করছে। উদাহরণস্বরূপ টিকটকার হৃদয় চক্রের দ্বারা প্রায় দেড় হাজার তরুণী পাচার হয়েছে, যাদের আগ্রহের বিষয় ছিল টিকটকের মডেল হওয়া ও খ্যাতি অর্জন করা।


তবে বাংলাদেশের শিশু পাচারের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বিশেষত গ্রামের মানুষ বিদেশী ছেলেদের হাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে তুলে দিতে দ্বিধা করে না। বিদেশফেরত বর হলে বাল্যবিবাহের আইনের তোয়াক্কা না করে মেয়েদের তুলে দিচ্ছে এবং তাদের নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে প্রতারণা চক্রের সদস্যরা। বিদেশে যাওয়ার পর আর তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। তাদের বেশির ভাগের স্থান হয় বিভিন্ন পতিতালয়ে। আলোচিত যশোরের মনিরুল ইসলাম মানুষের দারিদ্র্য ও অসচেতনতাকে পুঁজি করে বিয়ে করেন প্রায় ৭৫টি এবং তিনি এ প্রক্রিয়ায় পাচার করেন প্রায় দুই শতাধিক নারীকে৷। এছাড়া পাচারকারীরা তরুণীদের শিক্ষা, ভালো চাকরি ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দ্বারা প্রলুব্ধ করে। পাশাপাশি অপহরণ করেও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে।  এর ভয়াবহ ফল হচ্ছে পাচার ও শোষিত শিশুদের পর্যাপ্ত খাবার, বাসস্থান বা বস্ত্র ছাড়াই দাসের মতো আটকে রাখা হয়। জোর করে ভিক্ষা করানো, উটের জকি করা হয়, প্রায়ই গুরুতরভাবে নির্যাতনসহ তাদের পরিবারের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। জার্নাল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের (ভলিউম ২, ২০১১) রিপোর্টের মতে, প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশী শিশু বিভিন্ন সময়ে ভারতে পাচারের শিকার হয়েছে। এছাড়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় প্রায় ৪ হাজার ৫০০ নারী ও শিশু প্রতি বছর পাকিস্তানে পাচার হচ্ছে।


আইনত নারীদের অভিবাসনের খরচ স্বল্প হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও দালালের দৌরাত্ম্য ও অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার ফলে অভিবাসন ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে নারী ও শিশুদের ঋণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ কারণে যখন প্রতারণার বা বিভিন্নভাবে শ্রম শোষণ ও যৌন শোষণের শিকার হয় তখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না ঋণের কথা চিন্তা করে। ‘মানব পাচার রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী বিদেশে শোষণের শিকার, বিশেষ করে যৌন পাচারের শিকার ভিক্টিমদের ৪০ শতাংশই শিশু।


এছাড়া ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি শিশু যা অধিকাংশ সময়েই জোরপূর্বক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিশুরা পোশাক কারখানায়, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাছ ধরা ইত্যাদি বিপজ্জনক কাজেও যুক্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা পারিবারিক ঋণ পরিশোধে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পরিবার তাদের সন্তানদের বিক্রি করে দেয় দারিদ্র্য থেকে মুক্তির আশায় আবার কেউ কেউ তাদের শিশু সন্তানদের ভারতে পাঠিয়ে দেয় ‘ভালো’ সুযোগ সন্ধানের জন্য যা তাদের পাচারের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় মাদক বিশেষ করে ইয়াবা উৎপাদন ও পরিবহন করতে শিশুদের বাধ্য করেছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us