কদিন আগের কথা। পেনড্রাইভ নিতে এসেছিল মাসুদ। বলল, ‘মাঝে মাঝে বাইরে যাবেন, ভাইয়া। ঘরে বসে থাকবেন না। ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী হতে হবে তো!’
কূপমণ্ডূক হয়ে ঘরে বসে আছি—ব্যাপারটা যে এমন নয়, সে কথা আর বললাম না ওকে। এই কদিন পথে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে মাসুদের, তাই রণক্ষেত্রগুলো এড়িয়ে অফিসে যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার রোমাঞ্চের কারণেই কথাগুলো বলেছিল ও।
ইন্টারনেট-ব্যবস্থা চালু না থাকায় আমাদের লেখকেরা লেখা পাঠাতে পারছিলেন না তখন। কাউকে ফোন করে পুরো লেখার ডিকটেশন নেওয়ার অনুমতি চাইলেও কেউ কেউ সেই সময়টায় লেখা থেকে বিরত থেকেছেন। লোকবল ছিল না বলে কারও কারও বাড়ি থেকে পেনড্রাইভে করে লেখা আনা যায়নি।
তখন অফিস থেকেই বলা হলো, অন্তত চারটি জ্বলন্ত স্পট পেরিয়ে অফিসে আসার হাঙ্গামা না করে লেখালেখিটাই বেশি করে করা দরকার। অফিসের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে পেনড্রাইভ। তাতে পাতাগুলো সচল থাকবে। সত্যিই অসাড় নেট জগৎ কতভাবে যে কাজ করার পথ তৈরি করেছে, সে কথাগুলো লেখা থাকতে হবে।
এ সময়টায় পর্যাপ্ত লেখালেখি করেছি আমি এবং সুযোগ পেলেই বের হয়েছি বাড়ি থেকে। দেখার চেষ্টা করেছি, কেমন আছে সাধারণ মানুষ। দেখার চেষ্টা করেছি, ধ্বংসযজ্ঞ। যখন আমাদের বাড়ির জানালা দিয়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া দেখলাম একদিন, দেখলাম, নানা ধরনের মানুষ ভিড় জমাচ্ছে রাস্তায়, আবার পুলিশের গাড়ি এলে তারা সরে যাচ্ছে দূরে, তখন বুঝলাম, এই আন্দোলন এখন শুধু ছাত্রদের নয়।
তাহলে কি রাস্তায় বের হওয়া সব মানুষকে দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিতে হবে? না। বাজার থেকে বেরিয়ে যারা ভিড় করেছে রাস্তায়, তারা একেবারেই নিরীহ মানুষ। তারা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া দেখার জন্য বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। পরদিন যখন কারফিউ জারি করা হলো, তখনো তারা কারফিউর মধ্যে রাস্তায় নেমেছে কারফিউ দেখার জন্য। এদের মধ্যেই ছিল কিছু মতলববাজ মানুষ। এরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়েছে। আন্দোলনের ঝোল নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেবেছে, একটু নাড়া দিলেই সরকার পড়ে যাবে।জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দিনের পর দিন কারফিউ ছিল রাতে। আমার ভাই পত্রিকা অফিসে কাজ করতেন। ফিরতেন নাইট ডিউটি করে। কারফিউ পাস দিয়েই তাঁকে চলাচল করতে হতো।
এরপরও বহুবার সান্ধ্য আইনের দেখা পেয়েছে মানুষ। কিন্তু বেশ বড় একটা সময় কারফিউর মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। সাধারণ মানুষ কারফিউ ভালোবাসে না। রাস্তাঘাটে মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়া যাবে না—এ কেমন কথা!
দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ পেলেই যেকোনো আন্দোলনে ঢুকে আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সবই দুষ্কৃতকারীদের কাজ—এ রকম ভাবা বোধ হয় ঠিক না। জনমনে যদি ক্ষোভ জমে ওঠে, তাহলে সাধারণ মানুষও কখনো কখনো আইন ভেঙে থাকে। উসকানিদাতারা এই ফাঁকে ফায়দা লোটে। এবারকার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা যারা করেছে, তারা অন্যায় করেছে ঠিকই, কিন্তু জনগণ এ ঘটনা বা দুর্ঘটনার সময় শুধু দুষ্কৃতকারীদের নিন্দা করেই নিজের কর্তব্য সেরেছে বলে মনে হয় না।
এই সরকার কতটা জনমুখী, সে প্রশ্নটিও তারা নিজের কাছে করেছে। নির্বাচন যখন প্রহসনে পরিণত হয়, তখন জনগণ সরকারের ওপর আস্থা রাখে কী করে? ক্ষমতাসীন দলের মানুষেরা যখন জনগণের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে জনদুর্দশায় কষ্ট না পান, তখন তারা জনদরদি হন কী করে? হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগগুলোর সুরাহা না হলে জনগণ সরকারকে ছাড় দেবে কেন? এই ধরনের অসংখ্য উপাদান এসে যুক্ত হয়েছিল এই আন্দোলনের সময়। শিক্ষার্থীদের সেই ক্ষোভ, সেই ক্রোধকে আমলে না নিলে এই আন্দোলনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে না।