রফতানি তথ্য ‘সংশোধন’ নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে গেল, সেটা ধরে লেখার পর দু’সপ্তাহে কোনো নিবন্ধ লিখতে পারিনি যুগান্তরে। অন্য সংবাদপত্রেও। এর একটা কারণ ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা। কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো আংশিক ইন্টারনেট সংযোগেই চলতে হচ্ছে, তা কারও অজানা নয়। তবে এর ভেতর দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছি, নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশও কতখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের ওপর। সংবাদপত্রে দু’একটা লেখা ছাপা না হলে অবশ্য চলে; কিন্তু ইন্টারনেটের ওপর যাদের জীবিকা নির্ভরশীল, তাদের তো চলছে না।
অনলাইনে ব্যবসা করে যারা অন্যদেরও কিছু কাজের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদের ক্ষতি কতখানি? আর ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষতি? রফতানি বাণিজ্যও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ব্যাংকে রেমিট্যান্স অনেক কম এখন। ব্যাংকও বন্ধ ছিল। রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে আবার যোগ রয়েছে উদ্ভূত পরিস্থিতির। ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি চালু হলেও তাই এক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি নাও হতে পারে।
সেটা আরেক প্রসঙ্গ; হয়তো পরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তবে এই যে নানা ক্ষেত্রে আমরা নেটনির্ভর হয়ে পড়েছি, সেটা কিন্তু এক বড় ধরনের সংস্কার। এখান থেকে কোনো কারণে সরে গিয়ে দীর্ঘদিন ‘অ্যানালগ’ থাকার সুযোগ আর নেই। তাতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও হতে হয় খারাপভাবে আলোচিত।
রফতানি তথ্য সংশোধনের পর ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো) থেকে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরেও তারা ক’মাস এ সংক্রান্ত তথ্য দেবেন না। তথ্য প্রদানের ‘পদ্ধতি’ যথাযথ করতে হবে তাদের। তবে তথ্য না দিলেও রপ্তানি তো বন্ধ থাকবে না। আমরাও আশা করে থাকব, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ খাতে বড় অভিঘাত আসবে না। এমনিতেই রপ্তানি পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। সেটাকে সুবিধাজনক দেখাতে চাওয়ার কারণেই রপ্তানি তথ্যে বড় গোলযোগ ঘটেছিল কিনা, তা নিয়ে বাড়তি আলোচনার পরিবেশও আর নেই। এখন বরং ভেবে দেখতে হচ্ছে, সামনে ক্রিসমাসের ক্রয়াদেশ কতটা পাব। বাজারে তো প্রতিযোগীরা রয়েছে! অন্যান্য রফতানি খাত নিয়ে আলোচনাও কিন্তু তেমন নেই। আপাতত তৈরি পোশাক খাত নিয়েই আলোচনা। এ খাতে কাঁচামালের আমদানি নির্বিঘ্ন রাখার দাবিও উঠেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্দর ও ব্যাংকে যেন অতিরিক্ত মাশুল গুনতে না হয়, আছে সে দাবিও। তবে ইপিবিসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এরই মধ্যে স্থির করে ফেলতে হবে, রপ্তানি তথ্যে আর যেন কোনো গোলযোগ না হয়। রফতানিকারকরা একরকম বলবেন আর তারা দেবেন ভিন্ন চিত্র-এটা তো কাজের কথা নয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তথ্যগত গোলযোগ হলে কিন্তু তার প্রভাব পড়ে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের হিসাবে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তেও এর প্রভাব পড়ে। এর পুনরাবৃত্তি রোধটাও হবে একটা সংস্কার।
অবশ্য মুশকিল যে, এসব সংস্কারে আমরা মনোনিবেশ করছি নিজে থেকে নয়; আইএমএফের ‘পরামর্শে’। তাদের সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কর্মসূচিতে ঢুকে পড়াতেও এসব ঘটছে বৈকি। এই যে বছরে দু’বার মুদ্রানীতি গ্রহণ, তিন মাস অন্তর প্রবৃদ্ধির হিসাব জানানো-এসবও আমাদের করা উচিত ছিল নিজে থেকে। কেননা এতে দেশের স্বার্থ নিহিত।
মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা। এটা অর্জনে মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করতে হলে একটি অর্থবছরে একাধিকবার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তা করাই ভালো। আমরা দীর্ঘদিন যে ধরনের মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছি, তাতে তিন মাস অন্তরও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হতে পারে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, বিশেষত শ্রীলংকা যেভাবে মূল্যস্ফীতিকে বাগে এনে ফেলেছে, তা নিয়ে আলোচনা তো বন্ধ করা যাবে না।
তিন মাস অন্তর প্রবৃদ্ধির যে তথ্য এখন দেওয়া হচ্ছে, সে সিদ্ধান্তও কিন্তু নেওয়া হয়েছে অনেক পরে এবং আইএমএফের পরামর্শে। তাদের অনেক পরামর্শ নিয়ে অবশ্য সমালোচনা রয়েছে। সব দেশের ক্ষেত্রে একই ‘প্রেসক্রিপশন’ দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে বছরে চারবার প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশে তাদের পরামর্শটি ভালো। বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) এটার অনুসরণ শুরু করায় আমরা জানতে পারছি, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কেমন। নীতিনির্ধারকদের তো এটা জানা একান্ত প্রয়োজন। নইলে প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা বিভিন্ন খাতের পরিচর্যার সিদ্ধান্ত তারা নেবেন কীভাবে?
এক্ষেত্রে তথ্য অবশ্য সঠিক হতে হবে; খালি যথাসময়ে প্রকাশ করলে হবে না। সরকারি তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তো আজকের নয়। সরকারের ভেতর থেকেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; প্রকাশ্যে তাদের মধ্যে বিতর্কও হয় সংকট দেখা দিলে। সংকট উপস্থিত হওয়ার কারণও তথ্যের নিুমান। আইএমএফের পরামর্শ মেনে তিন মাস অন্তর শ্রমশক্তি সংক্রান্ত যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তার মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।