সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোটা সংস্কারকামী ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন-সংগ্রাম বিএনপি-জামায়াতের অনুপ্রবেশকারী ক্যাডারদের দ্বারা হাইজ্যাক হয়ে ইতিমধ্যেই সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি সময়মতো মেনে নেওয়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য কোটা রাখবে না তো কি রাজাকারদের নাতি-পুতিদের জন্য কোটা রাখা হবে?’ বক্তব্যটি ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ওই উক্তির পরপরই তারা স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার, দেশ বিকানো স্বৈরাচার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ ছাত্রছাত্রীরা কতখানি ক্রোধান্বিত হলে নিজেদের ‘ঘৃণিত রাজাকার’ অভিহিত করতে দ্বিধা করে না, সেটা কি আওয়ামী লীগের অন্ধ-সমর্থকেরা উপলব্ধি করতে পারছেন? মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার সব ছাত্রছাত্রীর ন্যায্য সাংবিধানিক অধিকার, যে অধিকার ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারই স্বীকার করে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্টের রায়ে সেই অধিকার হারাতে বসেছিল তারা। তাই, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের চাওয়া ছিল খুবই ন্যায্য।
ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলোর ন্যায্যতা অনস্বীকার্য, সেটা ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ স্বীকার করে নিয়ে রায় দিয়েছেন ২১ জুলাই। ওই রায়ে ৯৩ শতাংশ সরকারি চাকরি মেধার ভিত্তিতে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, বাকি ৭ শতাংশ দেওয়া হবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের কোটার ভিত্তিতে। এখন সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করে বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গিদের সহিংস ধ্বংসাত্মক সরকার পতনের আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চলছে। কী প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞ সারা দেশে, বেছে বেছে অর্থনীতিকে পঙ্গু করার কী ভয়ানক সন্ত্রাস! জামায়াত-শিবির যে দেশদ্রোহী অপশক্তি, তার অকাট্য প্রমাণ এই ধ্বংসযজ্ঞ।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের আর সরকারি চাকরির জন্য আবেদনের উপযুক্ত বয়স থাকার কথা নয়। এখনো যদি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা রাখা হয়, সেটা আসলেই ভোগ করবে তাঁদের নাতি-পুতিরা। অতএব ওই কোটা রাখার ভালো যুক্তি থাকতে পারে না, রাখলেও ৫ শতাংশের বেশি কিছুতেই নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই যৌক্তিক অবস্থানই নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে আরেকটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের তীব্রতার কাছে হার মেনে বর্তমান সরকারই সরকারি আদেশবলে কোটাব্যবস্থা বিলোপ করেছিল, যার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে। ওই মামলার রায়ে কোটা বাতিলের সরকারি আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাদের রায়ে মত প্রকাশ করেছে যে সরকার চাইলে কোটা বাড়াতে-কমাতে পারে, কিন্তু কোটা রাখার জন্য সংবিধানে নির্দেশনা রয়েছে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকার ‘লিভ টু আপিল’ মামলা করায় আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি এক মাসের জন্য স্থগিত করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা অবিলম্বে সংসদে বিল নিয়ে এসে কোটাব্যবস্থা বিলোপে আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলনে অনড় থাকে। ওই পর্যায়েই প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন আন্দোলনকারীদের মারধর করে মাঠ থেকে বিতাড়নের জন্য। এর বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়ায়। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশের পর লাশ পড়তে শুরু করে। আর সুযোগ বুঝে আন্দোলনকারীদের কাতারে ঢুকে পড়ে বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রদল-শিবিরের ক্যাডাররা এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা। ফলে তুমুল গতি-সঞ্চারিত হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে, যার পরিণামে ছাত্রলীগ মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-শিবির ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কোটা আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে এটাকে তাদের সরকার উৎখাতের এক দফার সহিংস সংগ্রামে রূপান্তরিত করার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্বালাও-পোড়াও, ঢাকার টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর রগকাটা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা, দুটো মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, ইন্টারনেটের ডেটা সেন্টার ধ্বংস, সাবমেরিন কেব্ল কেটে দেওয়া, সেতু মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন ওপড়ানো, পুলিশকে আক্রমণ, সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস—কোনো কিছুই আর বাকি থাকে না। ফলে কয়েক দিনেই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি মৃতের সংখ্যা ১৮৭ ছাড়িয়ে যায়। সরকার বাধ্য হয়ে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত ১২টা থেকে কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে, যা এখনো চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের ২১ জুলাইয়ের রায় কোটাব্যবস্থার যথাযথ সংস্কারের পথ নির্দেশ করেছে, যার ভিত্তিতে সরকার পরিপত্র জারি করেছে। আশা করি, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এই রায় মেনে নেবে। এসব সত্ত্বেও আশঙ্কা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রদল-শিবির ও জঙ্গিরা চলমান আন্দোলন সহজে থামতে দেবে না। অর্থনীতি পুরোপুরি থমকে পড়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় ইন্টারনেটনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশের সব কার্যক্রমই অচল হয়ে পড়েছে, যে জন্য বাধ্য হয়ে রবি থেকে মঙ্গলবার ব্যাংকিং সিস্টেমসহ বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার (বুধবার রাত থেকে ইন্টারনেট আংশিক খুলেছে)। কারফিউর কারণে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসের বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের পরিকল্পিত সন্ত্রাস কিছুটা থামলেও সরকার কত দ্রুত আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করতে পারবে, সেটা বলা কঠিন। অন্যদিকে যে কথাটা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তা হলো, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ব্যতীত মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করা, টেলিভিশন স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা সেতু ভবন ভাঙচুর কোনো দেশপ্রেমিক বাঙালির পক্ষে অচিন্তনীয় অপরাধ নয়কি? সরকারবিরোধী আন্দোলনকে যারা এ রকম জাতিদ্রোহী পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তারা কি বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্য? তাদের কি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা নয়?
অবশ্য কেউ এটাও বলতে পারেন যে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে আওয়ামী লীগই এই বিপদ ডেকে এনেছে। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে অসম্ভব করে দেওয়ার পরিণতি হয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাত অথবা দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। বোঝা প্রয়োজন, ভারত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। বিএনপি-জামায়াতকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সহজে আসতে দেবে না তারা। কারণ, তাদের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোতে ইনসার্জেন্সিকে আশকারা দিতে পারে বিএনপি-জামায়াত। ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেশের জনগণের বিরাট অংশের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। বিএনপি-জামায়াতের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবেন না। বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু হয়, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি নেই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতাসংগ্রামের কোনো স্বীকৃতি নেই বিএনপির ইতিহাসে। আর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ঘাতক-দালাল জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখনো পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্নে বিভোর। অতএব ১৫ বছরে অর্জিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নস্যাৎ করতে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিরা জাতীয় সম্পদ-ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে মোটেও পিছপা হবে না। তাদের পক্ষেই সম্ভব মেট্রোরেল স্টেশন, টেলিভিশন স্টেশন কিংবা সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগ করা।