এই লেখা যখন লিখছি, তখন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ছবি আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে। আবু সাঈদের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের ওই ছবি বহু যুগ ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ানো ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার মতে, আবু সাঈদকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে। একটি নয়, বেশ কয়েকটি গুলিতে (রাবার বুলেটে) তাঁর বুক ও মাথা ঝাঁঝরা হয়েছে। আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে যিনি রাবার বুলেট ছুড়েছিলেন, এর প্রাণঘাতী ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর সঠিক ধারণা ছিল বা আছে বলে মনে হয় না। সাধারণত নিশানা করা ব্যক্তির গায়ে চোট পৌঁছানোর জন্য এই বুলেট ব্যবহার করা হয়; প্রাণনাশ করার জন্য নয়।
যত দূর জানতাম, পুলিশের যদি একান্তই আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে হয়, তবে তাকে অবশ্যই কোমরের নিচে গুলি করতে হবে। জানি না সেই বিধি বলবৎ আছে নাকি পরিবর্তিত হয়ে সরাসরি তা ‘শুট টু কিল’ মানে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার নিয়মে রূপান্তরিত হয়েছে।
আন্দোলনে শুধু আবু সাঈদ মারা যাননি। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৩ জন নিহত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই নিহত ব্যক্তিদের অর্ধেকের বেশিই শিক্ষার্থী আর এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রও আছে। এমনকি একজন ছাত্রীও আছেন। এত তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এ আন্দোলনে যত প্রাণহানি হয়েছে (তা যে পক্ষেরই হোক), বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো আন্দোলনে তা হয়নি। এ ধরনের কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয়। এর মধ্যে র্যাবের একজন গাড়িচালককে তাঁর ভুলের জন্য যেভাবে আঘাত করা হয়েছে, তা–ও গ্রহণযোগ্য নয়।
এই লেখা পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয়নি। শুধু অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগই নয়; যেভাবে কাঁদানে গ্যাসের শেল ব্যবহার করার ছবি দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে এসব অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে।
তথ্যে প্রকাশ—কাঁদানে গ্যাসের বেশির ভাগ শেলের ক্যানেস্তারের ‘সেলফ লাইফ’ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে ক্যানেস্তারগুলোর গোলার আকারে আঘাত করার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ ‘কঠোর’ হতে গিয়ে রাবার বুলেটের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। তার সর্বশেষ শিকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের ছাত্র ফারহান আইয়াজ।
পত্রিকায় শিশু আইয়াজের হাস্যোজ্জ্বল ছবির সঙ্গে তার একটি উক্তি ছাপা হয়েছে, ‘এমন জীবন গড়ো যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।’ জানি না, কত দিন মানুষ আইয়াজের কথা মনে রাখবে। পত্রপত্রিকার তথ্য মোতাবেক, বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে গুলির কারণে।
জানি না, এসব হত্যার কী ব্যাখ্যা দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সরকারি দলের নেতারা এ আন্দোলনে বিরোধী গোষ্ঠীর ঢুকে পড়ার কথা বেশ জোরেশোরে বলে যাচ্ছেন। দৃশ্যত এই ছাত্রছাত্রীরা যে আন্দোলন করে আসছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ। অহিংসভাবে তাঁরা তাঁদের দাবি তুলে ধরছিলেন। সেই দাবির মধ্যে সরকারবিরোধিতা ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন মেধার স্বীকৃতি। তাঁরা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিলেকশন পদে কোটার সংস্কার, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি–নাতনিদের জন্য কোটা রাখা আছে।