বৃহস্পতিবার পৌনে ১২টা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় গ্রিন সুপার মার্কেটের উল্টো দিকে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির সামনে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে। কোনো উত্তেজনা নেই। রাস্তায় রিকশা চলছে। আশেপাশের পরিবেশও শান্ত।
একটু এগিয়ে দ্য ডেইলি স্টার ভবনের সামনে ফুটওভার ব্রিজ পার হয়ে রিকশা নিয়ে রওনা হই হাতিরঝিলের উদ্দেশে। সাতরাস্তার মোড়ে পেট্রোল পাম্পের পাশে অনেক মানুষ, যাদের অধিকাংশের হাতেই লাঠি। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাদের কেউই শিক্ষার্থী নন। পাশেই টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি।
হাতিরঝিল চক্রাকার বাসের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেলো টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। জানানো হলো বাস বন্ধ। কতক্ষণ আগে বন্ধ হয়েছে? একজন কর্মী জানালেন, কিছুক্ষণ আগেই। কেন বন্ধ? তিনি বললেন, 'গ্যাঞ্জাম হচ্ছে'।
বাস না পেয়ে রিকশায় রওনা হই নিকেতনের দিকে। বেগুনবাড়ি এলাকায় আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির সামনে দেখা গেলো শিক্ষার্থীদের জটলা। তাদের অনেকের হাতে লাঠি। অবস্থা দেখে মনে হলো তারা জড়ো হচ্ছেন।
আরেকটু উত্তরে গিয়ে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির সামনেও একই দৃশ্য। গলায় ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড ঝোলানো কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখা গেলো লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সেখানের পরিবেশও শান্ত। কোনো উত্তেজনা নেই।
অফিসে ঢুকে টেলিভিশন অন করার পরে স্ক্রলে দেখা গেলো:
১. বাড্ডায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, রামপুরায় পুলিশ বক্স ভাঙচুর।
২. মিরপুরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ; রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।
৩. চট্টগ্রামে শাহ আমানত সেতু অবরোধের চেষ্টা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ; ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আটকে আছে শত শত যান।
৪. ফোর জি নেটওয়ার্ক বন্ধ।
আগের দিন বুধবার সন্ধ্যায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—যেখানে তিনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি কোটা সংস্কার ইস্যুতে আদালতের চূড়ান্ত রায় আসা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
সেইসঙ্গে তিনি বলেন, এই আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে নাশকতা চালাচ্ছে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাবেন। শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং রাতেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের তরফে বৃহস্পতিবার সারা দেশে 'কমপ্লিট শাটডাউন'র ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া সব বন্ধ থাকবে।
প্রশ্ন হলো, সরকারির চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটি যৌক্তিক আন্দোলন; যে আন্দোলনের দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের সমর্থন আছেন বলে মনে করা হয়; যে আন্দোলনটি গড়ে তুলেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং যে আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ—সেটি কেন এরকম সহিংস হয়ে উঠলো? পুলিশ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কেন গুলি চালালো?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ কোন পরিস্থিতিতে এবং কোন সময়ে গুলি করতে পারবে, তার কিছু নিয়ম-কানুন আছে। কিন্তু পুলিশ কেন এত বেপরোয়া হয়ে উঠলো? কেন বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে একদিকে সাধারণ শিক্ষার্থী, অন্যদিকে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল? শিক্ষার্থীদের কেন রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো? শিক্ষার্থীরা কি এটা চেয়েছিলো?
ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন একত্র হয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর করবে? তার বিপরীতে কেনই বা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হবে? সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধটা কোথায়? কেন একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে এরকম সহিংসতার দিতে ঠেলে দেওয়া হলো? আন্দোলনটি কি তাহলে আর কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমিত নেই বা আন্দোলনের নেতৃত্ব কি আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে নেই?
২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে দেওয়া সরকারের প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ বলে রায় দেওয়ার পরেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের কর্মসূচিগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ। শুরুতে ছাত্রলীগের অবস্থানও ছিল সহনশীল। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখা গেলো বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীরা মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছেন। বিশেষ করে গত রবিবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের তরফে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পারেননি বা ভুল বুঝেছেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, তারাও যে স্লোগান দিয়েছেন, সেটিরও একটি অংশ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। অর্থাৎ একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ যে রয়ে গেছে সেটি স্পষ্ট। যে গ্যাপটি হাইকোর্টের আদেশের পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থাৎ কোটা বাতিল-সম্পর্কিত হাইকোর্টের রায় আসার পরেই যখন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে গেলো, তখনই সরকারের তরফে যদি তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে রায়ের বিষয়টি বোঝানো যেতো এবং পূর্ণাঙ্গ রায় আসার পরে সেই আলোকে কোটা সংস্কারের আশ্বাস দেওয়া হতো—তাহলে পরিস্থিতি এত দূর পর্যন্ত গড়াতো বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও যেভাবে আদালতে একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয় জরুরি সংসদ ডেকে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন, সেখানেও তাদের 'ইমম্যাচিউরিটি' স্পষ্ট। কেননা যেকোনো আইন প্রণয়নের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে এবং এটি সময়সাপেক্ষ।
তাছাড়া কোটা সংস্কারের বিষয়টি এমন কোনো জীবন-মরণ সংকটের বিষয় নয় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ ডেকে আইন পাশ করতে হবে। এটি বাস্তবসম্মতও নয়। তাছাড়া কোটা সংস্কারের জন্য যে আইন পাশ করার প্রয়োজন নেই, বরং আদালতের রায়ের আলোকে সরকার নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়েই বিষয়টির সুরাহা করতে পারে—সেই বিষয়টিও হয় শিক্ষার্থীরা বোঝেননি কিংবা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়নি।
সব মিলিয়ে সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বা পরস্পরকে বোঝার যে ঘাটতি—সেটিই আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই যে প্রোপাগান্ডাটি চালানো হয়েছে, সেটি হলো তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করছেন। মূলত এই কথা বলে তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে—যা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ যে ঢুকে গেছে—সেটিও এখন স্পষ্ট। কেননা বুধবার রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকায় সহিংসতা হয়েছে; হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেওয়া; থানায় আক্রমণ এবং তার আগে ফার্মগেটের মেট্রোরেল স্টেশন ভাঙচুর করার মতো ঘটনা ঘটেছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন—এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
তাছাড়া ঘটনার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্তা নেই। দেশের মানুষও এটা বিশ্বাস করে।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এই কাজগুলো কারা করলো? যারা আন্দোলনটিকে নস্যাৎ করতে চায় কিংবা ছাত্রদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অন্য কোনো স্বার্থ হাসিল করতে চায়—এই ঘটনার পেছনে তাদের ইন্ধন রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাস্তবতা হলো, সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা যারা সরকারকে বিপদে ফেলতে চায় তারা যেকোনো অরাজনৈতিক আন্দোলনকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এরকম ঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছে।
এমতাবস্থায় জনমনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো, এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে এবং এর পরিণতি কী হবে? আশার কথা হলো, বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে তারা ক্লাসে ফেরার পাশাপাশি দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। কিন্তু রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাঈদ হত্যার ঘটনা তদন্তে পুলিশের চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, নিজেদের বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশ কীভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে? এই ধরনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত বিচার বিভাগীয় তদন্তই কাম্য। এবং সেই তদন্তও হতে হবে নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত।