সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, রাজস্বের মতিউর রহমান, একই বিভাগের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুন, সিলেটের কর কমিশনার এনামুল হক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি কামরুল হাসান, পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলী, পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর—তাঁরা একেকজন এখন ‘বিখ্যাত’ ব্যক্তি।
স্বীয় কর্মগুণে তাঁরা রাতারাতি ‘স্বনামধন্য’ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। স্বনামধন্য বলছি এ জন্য যে তাঁদের নাম শুনলে কাউকে বলে দিতে হয় না, তিনি কে এবং কেনইবা খ্যাতি অর্জন করেছেন। সংবাদপত্র, টেলিভিশনের খবরে তাঁরা এখন শিরোনাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। তাঁদের এই বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক কালো অধ্যায়। সে কাহিনি সরকারি পদে থেকে ক্ষমতা ও সুযোগের অপব্যবহার করে শত থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার।
আচ্ছা, তাঁদের যদি ‘চোর’ বলে সম্বোধন করি, তাহলে কি কারও আপত্তি আছে? কিংবা কোনো আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা আছে? থাকলেও কোনো আপত্তি নেই। কেননা, অভিধানে চোরের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তাতে এই ব্যক্তিরা ওই অভিধায় অভিহিত হওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার রাখেন।
উইকিপিডিয়ার চুরির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘চুরি হলো কোনো ব্যক্তির যথাযথ মালিক বা তাঁর পক্ষে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা সম্মতি ব্যতীত সম্পত্তি বা পরিষেবাগুলো হস্তগত করার কাজ, যা এর সঠিক মালিককে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।’ আর যে ওই কাজে লিপ্ত হয়, তাকে বলে ‘চোর’। চুরির আরও কয়েকটি সমার্থক শব্দ রয়েছে—যেমন ডাকাতি, লুণ্ঠন, আত্মসাৎ ইত্যাদি। আমাদের এ দেশ বা রাষ্ট্রটির মালিক জনগণ। সংবিধানে তা-ই লেখা আছে।
আর সরকার হলো জনগণের পক্ষে দেশ বা রাষ্ট্রকে পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তো সেই জনগণ বা সরকারের অগোচরে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করে সরকারি পদে থাকার সুযোগের অপব্যবহার করে গোপনে অবৈধভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করাকে তো চুরিই বলা যায়। সে হিসেবে উপরোল্লিখিত ‘মহাজন’ ব্যক্তিদের চোর সম্বোধনে ‘কসুর’ হওয়ার কথা নয়। চোর সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে একজন সেদিন বলছিলেন, যে গেরস্তের ঘরে সিঁধ কেটে চুরি করে, সে যেমন চোর, আর যে ব্যক্তিটি স্যুট-টাই পরে অফিসে বসে কলম ঘুরিয়ে অবৈধ আয় করে, সে-ও চোর।
পার্থক্য সিঁধকাটা চোরকে ভোররাতে খালের পানিতে গোসল করে শরীরের মাটি পরিষ্কার করতে হয়, আর অফিশিয়াল চোরদের সেটা দরকার হয় না। তাদের পোশাক-আশাক থাকে পরিষ্কার, তারা সমাজে চলাফেরা করে সাধুবেশে।
ওপরে যাঁদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের কীর্তি-কাহিনি এখন সবাই জানেন। আর এই জানার কৃতিত্ব সরকারি কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের নয়। পুরোটাই গণমাধ্যমের। কেউ হয়তো বলতে পারেন, নিজে গণমাধ্যমকর্মী বিধায় আমি এ কথা বলছি। কিন্তু একটু পর্যালোচনা করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এযাবৎ দেশের যত বড় বড় পুকুর ডাকাতির খবর জনসমক্ষে এসেছে, তার সবই গণমাধ্যমে উঠে আসার পর জনগণ জানতে পেরেছে। আর তার পরপরই সরকারি সংস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশনকেও কাছা মেরে মাঠে নামতে দেখা গেছে। এ যেন সেই ‘মরা সাপের গায়ে লাঠি দিয়ে দুইটি আঘাত করে সাপ মারতে হয় এভাবে’—বলা গ্রামের সেই ‘সাহসী’ মানুষটির উদাহরণ। একেবারে তরতাজা উদাহরণটি দিই।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সংস্থাটির কতিপয় কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালকের শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার খবরটি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুসন্ধানী রিপোর্টেই প্রথম তুলে ধরা হয়েছিল। এরপর অপরাপর সংবাদমাধ্যমে তাদের কুকীর্তির খবর ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। গাড়িচালক আবেদ আলীসহ পিএসসির যে ১৭ জন এখন পুলিশের খাঁচায় বন্দী, তাঁদের চিনিয়ে দিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
পিএসসির ওই ‘কীর্তিমান’দের মধ্যে চালক আবেদ আলীর নাম এখন সবার মুখে মুখে। খবরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারবার করে তাঁর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য, ঢাকা-মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল সম্পদ গড়ার কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম, একজন সাংবাদিক আবেদ আলীকে প্রশ্ন করছেন, ‘ড্রাইভারি করে আপনি এত টাকার মালিক হলেন কী করে?’ তিনি উত্তরে বলছিলেন, ‘ড্রাইভারি চাকরি করেছি তো ১৫ বছর আগে, এখন তো আমি ব্যবসায়ী।’ বটে, তিনি এখন একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী।
কিন্তু স্বল্প বেতনের একজন চালক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার মতো বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় পেলেন? পত্রিকায় দেখলাম, তিনি তাঁর এলাকায় নাকি প্রচুর দান-খয়রাত করতেন। তিনি ও তাঁর ছেলে সোহানুর রহমান সিয়াম চলাফেরা করতেন কোটি টাকা দামের গাড়িতে।