রপ্তানি আয়ের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল থাকার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা বলেছে, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্য রপ্তানির একই তথ্য একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত করেছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে অপ্রযোজ্য মাশুল ও স্যাম্পল বা নমুনা পণ্যের মূল্য যোগ করেছে এবং এমনকি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রীত পণ্যের মূল্যকেও রপ্তানি হিসেবে দেখিয়েছে। উল্লিখিত ভ্রান্তিজনিত গরমিলের পরিমাণ শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার। ধারণা করা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে হোক কিংবা অনবধানতাবশত, এ ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্য ইপিবি আরও বহু আগে থেকেই দেখিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট এবং এসবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। বিষয়টি ইপিবির পেশাদারিত্বকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে, সন্দেহ নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তথ্য সংরক্ষণে এত অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সবচেয়ে বেশি। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘এটা ছোটোখাটো কোনো ভুল না। সংখ্যাও অনেক বড়। কোনো আমলা কাউকে খুশি করার জন্য এমনটা করেছে কিনা, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। বিশাল আমলাতন্ত্রের বিরাট দপ্তরগুলো যথাযথ কাজের উপযুক্ত কিনা, সেই প্রশ্নও উঠবে’ (বণিক বার্তা, ৭ জুলাই ২০২৪)।
তাঁর এ বক্তব্যের সূত্রে এ কথা বলা অন্যায্য হবে না যে, এ ধরনের দুর্বল পেশাদারিত্ব ও অস্বচ্ছ আচরণ শুধু ইপিবিতেই নয়, অন্যান্য বহু রাষ্ট্রীয় দপ্তরেও সমানতালে বিরাজমান। বাংলাদেশের বহু জেলা যে এখন ‘নিরক্ষরতামুক্ত’, ‘অপরাধমুক্ত’, ‘ভূমিহীনমুক্ত’ কিংবা ‘দারিদ্র্যমুক্ত’, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা ইতোমধ্যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ইপিবির উল্লিখিত ভুল তথ্য চিহ্নিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে এখন তার জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয়, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ, দারিদ্র্যের স্তর, বৈশ্বিক আয়শ্রেণি ইত্যাদি অনেক কিছুই সংশোধন করতে হবে। এর বাইরেও অষ্টম পঞ্চম পরিকল্পনা (২০২০-২৫) ও নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২৫-৩০) খাতওয়ারি যেসব মূল্যায়ন ও লক্ষ্যমাত্রা প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলোও অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন হবে। তবে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কি এখন এতগুলো তথ্য একসঙ্গে সংশোধন করতে সহজেই রাজি হবেন?
রাষ্ট্র, দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবলে এ ত্রুটিগুলো তাদের স্বীকার করে নেওয়াটাই উচিত। পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এটি স্বীকার করে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সমন্বয় সাধনের তো কোনো বিকল্প নেই। শুধু ইপিবির ভ্রান্তিজনিত তথ্যই নয়, এ ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ সব তথ্য একসঙ্গে সংশোধন করে ফেলাই উত্তম। নইলে কিছুদিন পরপর এরূপ নানা ধরনের ভুল আলাদা আলাদাভাবে সামনে আসবে, যেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন পেশাদারিত্ব রক্ষা করে নিষ্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
তবে সব খাতের সব ভুল একসঙ্গে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় নিষ্পন্ন করতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন একটি ‘জাতীয় পরিসংখ্যান সংশোধন ও সমন্বয় কমিশন’ গঠন। প্রস্তাবিত কমিশনটি বস্তুত সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের নিয়েই গঠন করা যেতে পারে, যার নেতৃত্বে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বা এ পর্যায়ের কাউকে রাখা যেতে পারে।
একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি উত্তম পরিকল্পনা। বলা হয়ে থাকে যে, ‘একটি উত্তম পরিকল্পনা হচ্ছে এর অর্ধেক বাস্তবায়নের সমান’ (এ গুড প্ল্যান ইজ হাফ ডান)। অন্যদিকে একটি উত্তম পরিকল্পনার অতি আবশ্যিক পূর্বশর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে নির্ভুল তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান। এখন কথা হচ্ছে, যে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষায় আমরা নিরন্তর গলদঘর্ম হচ্ছি, সেটি নিশ্চিত করার জন্য নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল পরিসংখ্যানের সহায়তা ও সমর্থন কোথায়? ইপিবির তথ্যের মতো ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্য দিয়ে একজন জেলা প্রশাসক যখন বলেন যে, তার জেলায় আর কোনো নিরক্ষর লোক নেই কিংবা একজন এসপি যখন বলেন যে সে জেলা অপরাধমুক্ত, তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমপি যতই দাবি করুন না কেন, ওই জেলা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তখনও আসলে সেখানকার লাখ লাখ অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ নিয়ত নানা অপরাধের শিকার হচ্ছে। আর প্রায় সব ক্ষেত্রে সে ধরনের উন্নয়ন নিয়েই আমরা এগোচ্ছি, যে উন্নয়ন টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।