অধ্যাপক কবি হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘...নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/ সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে/ চলে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল/ নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, ...’
হয়তো এখনো পুরোপুরি যায়নি। তবে যাবে যে সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ দেখি না। নষ্টদের আধিপত্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আর বোধ হয় খুব বেশি দেরি নেই সবকিছু তাদের সম্পূর্ণ অধিকারে যাওয়ার। না হলে এসব কিসের আলামত! গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ বিভাগের শীর্ষ থেকে নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজস্ব বিভাগের মধ্যম সারির কর্মকর্তা, সরকারি কর্ম কমিশনের একজন গাড়িচালক থেকে কোন পর্যায় পর্যন্ত নষ্টদের অধিকারে গেছে, তা এখনো অজানা। আবার শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আলোচিত কর্মকাণ্ড, এসব তো নষ্টদের আধিপত্য বৃদ্ধিরই প্রমাণ। সবকিছু নিশ্চয়ই এখনো প্রকাশ হয়নি। হয়ও না কখনো। তাতেও যে হারে আধিপত্য ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, তাতে সবকিছুই যে নষ্টদের অধিকারে যাবে, কোনো কিছুই যে আর অবশিষ্ট থাকবে না, তা এখন সবাই বিশ্বাস করে।
নষ্টদের আধিপত্য বিস্তারের খবরাখবর একটির পর একটি প্রকাশিত হচ্ছে। পুলিশ এবং রাজস্ব বিভাগের বেশ কয়েকজন নষ্ট-ভ্রষ্ট এখন নিবিড় অনুসন্ধান থেকে আদালতের দিকে যাওয়ার পর্যায়ে আছেন। এরই মধ্যে সামনে চলে এসেছে সরকারি কর্ম কমিশন। পিএসসির দুর্নীতির মধ্যমণি হিসেবে একজন গাড়িচালক চিহ্নিত হলেও তাঁর সঙ্গে আরও যে কত রাঘববোয়াল জড়িত আছেন, এরও নিবিড় অনুসন্ধানের বিষয় হওয়া জরুরি। এমনকি বিসিএসের যে পরীক্ষাগুলোয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত, তার কোনটিতে কারা চাকরি পেয়েছেন, তা চিহ্নিত করেও দুর্নীতির শিকড় এবং দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করা দরকার। কারণ তাঁরা সরকারের ভেতরে থেকে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন।
অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে পিএসসি-সম্পৃক্ত দুর্নীতি হয়েছে মূলত নন-ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে। কিন্তু এ কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ বেশ কয়েকটি বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা তথ্য-প্রমাণসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ বাতিলও করেছিল। এখন অবস্থা দেখে এটাও ধারণা করা যায় যে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পিএসসির নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় ক্যাডার সার্ভিস বা আমলাতন্ত্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এসব বিষয়ের সঠিক অনুসন্ধান এবং প্রতিকারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পিএসসির পাশাপাশিই চলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রসঙ্গ হচ্ছে সরকারের প্রবর্তিত অবসরকালীন নতুন পেনশনপদ্ধতি ‘প্রত্যয় স্কিম’। এই আন্দোলনের সূত্রেই আরও একবার আলোচনায় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং অনেক শিক্ষকের গুণমানের বিষয়। বলা বাহুল্য, সেখানেও নষ্ট-ভ্রষ্টদেরই আধিপত্য ক্রমবর্ধমান।
শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যেই শুরু হলো সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতির বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যত দূর জানি, কোটায় নিয়োগের প্রশ্ন আসে কোনো প্রার্থীর প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয় যে কোটা সুবিধার জন্য একজন ফেল করা প্রার্থী চাকরি পাচ্ছেন। তবে কোটার হার নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন আছে। আর কোটাপদ্ধতি প্রয়োগের মধ্যকার অস্বচ্ছতাও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও বিষয়টি উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে, তারপরও আন্দোলন যে হতে পারে না, তা নয়। তবে সেই আন্দোলন থেকে যদি স্লোগান ওঠে ‘মুক্তিযোদ্ধার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ (এ রকম হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে), তাহলে এই যৌক্তিক আন্দোলনেও যে নষ্টদের আধিপত্য বিস্তারের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সে কথা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এসবের মাঝখানে আমরা আরও একটি আন্দোলন দেখলাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাঁদের দাবি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করা, অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্তদের চাকরি স্থায়ী করা এবং পল্লী বিদ্যুতায়নব্যবস্থায় নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ বন্ধ করা। দেশের মোট ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি হচ্ছে ছোট ছোট শহর-বন্দর-অঞ্চল এবং বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মেরুদণ্ড। বিআরইবি এবং সমিতির মধ্যে অনেক বৈষম্যই আছে। বিদ্যমান সেই সব বৈষম্যের অনেকটাই দূর করা সম্ভব এবং প্রয়োজন।
আর পল্লী বিদ্যুতায়নব্যবস্থায় নিম্নমানের মালামাল (তার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সবকিছু) সরবরাহের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কেনাকাটার বিষয়। হাজার হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা। সেই কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। তাই আন্দোলন স্থগিত রয়েছে। এর মধ্যে ১০ জুলাই বিআরইবির কেনাকাটার বিষয়ে গণমাধ্যমে একটি খবর বেরিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দামের প্রিন্টার কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৯ হাজার টাকা করে। এমনি আরও কয়েক প্রকার সামগ্রী কেনায় বিপুল অর্থের নয়ছয় হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ পেয়েছে।
১০ জুলাই বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, ‘বিগত কিছু বছর ধরে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘন ঘটিয়ে ক্যাডার পদগুলোতে ভিন্ন নিয়োগবিধির আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাডহক ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুষ্কৃতকারী কর্মকর্তা। চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন হওয়ায় আমরা এ নিয়ে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তাঁদের অনিয়ম থামানো যায়নি; বরং এই অন্যায়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।’