নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছেন। এ সফরে দুই দেশের মধ্যে অনেক সমঝোতা স্মারক ও দলিল সই হয়েছে। ঘোষণাপত্রও স্বাক্ষরিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা বাড়ছে। তবে এটা মনে করার কারণ নেই, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক কূটনীতির চর্চা করছে। তা ছাড়া এই সফরে উন্নয়ন কিংবা ‘কানেক্টিভিটি’র বাইরে নিরাপত্তাগত কোনো বিষয় নেই। তবে ‘ডি ডলারাইজেশন’ তথা বৈদেশিক লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রা বা ভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারের যে বিষয়টি বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে, সেটা এ সফরে দেখা গেছে। বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ইউয়ান অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন।
আগে আমরা দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় লেনদেনে ডলারের চিন্তা করতাম। এখন আমরা নিজেদের মুদ্রা বা সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রায় বিনিময় করছি। ভারতের সঙ্গেও আমাদের টাকা ও রুপিতে লেনদেন হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন দেশের মুদ্রায় লেনদেন হচ্ছে। এই প্রবণতা আরও বাড়বে। এখন আমরা দেখছি ডলারের রিজার্ভ আছে কিনা। হয়তো সেখানে ভারতের রুপি কিংবা চীনের ইউয়ানেও রিজার্ভের গণনা হচ্ছে। ডলারের বিকল্প মুদ্রায় চীনের সঙ্গেই যে লেনদেন হচ্ছে তা নয়, এমনকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণও চীনা মুদ্রায় পরিশোধের আলোচনার বিষয়টি আমরা জানি।
আমরা দেখেছি, চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গেছেন। এই উভয় সফর ঘিরেই তিস্তা চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় স্বাভাবিকভাবেই ভারতের স্বার্থ আছে। অন্যদিকে চীনও এ ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখিয়েছে। এটি শেষ পর্যন্ত কীভাবে বাস্তবায়ন হয়, তা দেখতে হবে। তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ নদী। এই যৌথ নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারত যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার সমীক্ষা করতে একটি কারিগরি দল আসবে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হয়তো বিষয়টি সামনে গড়াবে। চীনও স্পষ্ট করেছে, ভারত এর মধ্যে থাকলে তাদের আপত্তি নেই। চীনের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি আছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। তবে ভারত একা কতটা পারবে, তাও বিবেচ্য। এটা অনেক বড় প্রকল্প। এতটা খরচ তারা করবে কিনা, সে প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। সে জন্য চীনকে সঙ্গে রাখলে আমি মনে করি, ভারতেরও লাভ। তবে আপাতত ভারতীয় কারিগরি দলের আগমন এবং তাদের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তারপর বোঝা যাবে ভারত একা করবে, নাকি চীনকে সঙ্গে নেবে; নাকি অন্যান্য দেশ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কিংবা বিশ্বব্যাংক যুক্ত হবে– তখন বোঝা যাবে।
কোনো দেশ থেকে ঋণ নিলে তা পরিশোধের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। সে জন্য এবার চীনা বিনিয়োগেরও চুক্তি হয়েছে। চীন বলেছে, বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের রিজার্ভ বাড়তে পারে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, চীনা ঋণে যে সুদ বা ইন্টারেস্ট আমাদের দিতে হবে, তা অন্য অনেক দেশের চাইতে কম। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এমনকি জাপানের শর্ত এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। চীনের চেয়ে জাপানের কাছে আমরা কিন্তু আরও বেশি ঋণী। অথচ বিষয়টি ওইভাবে আলোচনা হয় না।
বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য আমরা চীন থেকে ঋণ বা বিনিয়োগ সহযোগিতা নিচ্ছি। তবে এখানে চীনের স্বার্থও যে নেই, তা নয়। এখানে বিনিয়োগ করলে তাদের লাভ। তাদের জনশক্তি, বিশেষজ্ঞ ও উপকরণ ব্যবহার হবে। যদিও বিনিয়োগের ধরন নিয়ে আলোচনা আছে। এখানে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টেরও বিষয় আছে। তবে বাংলাদেশ যে সবার কাছ থেকে সমান সুবিধা পাচ্ছে, এমন নয়। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু জ্বলন্ত উদাহরণ। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকেরই তহবিল দেওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা দেয়নি, যদিও সেটা ভিন্ন আলাপ। এটা বলতে হবে যে, পদ্মা সেতু হওয়ার পর সবারই লাভ হচ্ছে। পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে চীন। বস্তুত এই রেললাইন চীনা উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরই (বিআরআই) অংশ। চীনের এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। সেই তুলনায় পশ্চিমা বিশ্বের পয়সা কমে গেছে। সে জন্য বাংলাদেশ চাইবে চীনের এই সুবিধা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরে যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে আমরা দেখছি প্রযুক্তিগত সহায়তাও রয়েছে। রয়েছে ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদারকরণ, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি, ডিজিটাল সংযোগ প্রকল্পের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণের সমাপ্তির ঘোষণা, ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের সঙ্গে একক পয়েন্ট মুরিং-এর ট্রায়াল রান সমাপ্তির ঘোষণা। চীনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সক্ষমতা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারলে আমরাও তাদের থেকে উপকৃত হবো।