ব্রিটেনে লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসা কতটা ইতিবাচক

যুগান্তর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৪, ১২:৩২

যুক্তরাজ্যে গত ১৪ বছরের অধিককাল কনজারভেটিভ পার্টি সরকার পরিচালনায় ছিল। ঘটনাবহুল বিশ্বে অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ-বিগ্রহসহ নানা কর্মযজ্ঞে তারা ছিল মার্কিন সরকারের আজ্ঞাবহ। বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চার সূতিকাগার হিসাবে খ্যাত যুক্তরাজ্যে বহু বছর পর ক্ষমতার রদবদল হলো। লেবার পার্টি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ করেছে। যুক্তরাজ্যকে নতুন করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। নতুন মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে বড় চমক হিসাবে যুক্তরাজ্যের ৮০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতি-আদর্শ বৈশ্বিক প্রভাব বলয়ে পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের শাসনকাল তেমন গ্রহণযোগ্য ছিল না। দেশীয় ও বৈশ্বিক সংকট নিরসনে তাদের নতজানু নীতি সর্বত্রই নিন্দিত হয়েছে। বিশেষ করে গাজায় অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও বর্বর হত্যা-গণহত্যার জন্য দায়ী ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন বিবেকবান মানুষের সমর্থন পায়নি। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বেপরোয়া আচরণ তাদের কাছে অমানবিক মনে হয়নি। বরং মার্কিন সরকারের পক্ষে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন গাজার নির্মমতাকে অধিকতর জোরালো করেছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনির আর্তনাদ, ভৌত অবকাঠামোর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ, হাসপাতালসহ নারী-শিশু-কিশোরদের প্রতি তাদের আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। এসব সভ্যতাবিধ্বংসী অপকর্মকে সায় দিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার সর্বত্রই ঘৃণিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ডেগেনহাম ও রেইনহাম শাখার কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান মাহদি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যের ওপর। এ কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়েছে। ফলস্বরূপ দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয় ও সংকুচিত পরিবারের বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাসস্থানের দামে আকাশ ছুঁয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টি এ আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য লড়াই করেও ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপক অর্থনৈতিক অসন্তোষ কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন হ্রাস করে তাদের নির্বাচনি পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।


অর্থনৈতিক সমস্যার পর যুক্তরাজ্যের নির্বাচন ঘিরে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল অভিবাসন সমস্যা। কারণ কনজারভেটিভ পার্টির সরকারের আমলে যুক্তরাজ্যে অধিকসংখ্যক অভিবাসী ঢুকেছে। এমনকি অভিবাসীর সংখ্যা কমাতে সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে বিতর্কিত রুয়ান্ডা বিলও পাশ করে।


যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে রেকর্ডসংখ্যক আন্তর্জাতিক অভিবাসী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে, যাদের অধিকাংশই এসেছে তাদের ক্যারিয়ার ও শিক্ষার জন্য। এছাড়া এর একটি বৃহৎ অংশ অবৈধভাবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছে। তবে যুক্তরাজ্যে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের রুয়ান্ডা পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি রুয়ান্ডা পরিকল্পনাটি শুরু হওয়ার আগেই মৃত ও সমাহিত হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন। নতুন সরকার পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করে ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে মানব পাচারকারী চক্রগুলোকে ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও লেবার পার্টি বরাবরই অভিবাসন নীতিতে ছিল কঠোর। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্যরা এখনো পর্যন্ত তাদের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করছেন যে, কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের ভূখণ্ডে থাকতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তি করে দ্রুত তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর নীতিতে বিশ্বাসী লেবার পার্টি।


বিশ্লেষকদের মতে, লেবার পার্টির সরকারের কার্যকারিতা ও সফলতা অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল। মূল্যস্ফীতি কমানো, অর্থনীতি মেরামত, অভিবাসন সংকটের সমাধান করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে লেবার পার্টির সরকার। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর এবং ভূরাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে স্পর্শকাতর সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে তাদের। পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে বাড়তে থাকা হুমকির মুখে নতুন সরকারকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন লেবার পার্টির জন্য সুখকর হবে না বলেই অনুমেয়। ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রশ্নে লেবার পার্টি প্রথাগত ব্রিটিশ রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে কোনো অবস্থান নেবে কিনা তাও সুস্পষ্ট নয়। তবে লেবারদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যারা জায়নবাদী নৃশংসতাকে ছাড় দেননি। পশ্চিমা বিশ্বের চিরাচরিত আধিপত্যবাদী ও স্বার্থতাড়িত ধ্যানধারণার বিপরীত চিন্তা-চেতনার লোকও বিদ্যমান। তাই এটুকু আশা করা যায় যে, বর্তমান লেবার পার্টি সরকার ফিলিস্তিনে রক্তপাত বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বিশ্ববাসী অধীর আগ্রহে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অব্যাহতভাবে প্রভাব রাখবে।


সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতি কতটা বদলাবে সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভোটের আগে লেবার পার্টি ঘোষিত নির্বাচনি ইশতেহারে পররাষ্ট্রনীতির পরিকল্পনা বিষয়ে দেখা যায়, আপাতত ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরেই থাকতে আগ্রহী যুক্তরাজ্য। তারা ইইউর একক বাজার এবং কাস্টমস ইউনিয়নে ফিরতে চায় না। ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের পর বাণিজ্য, গবেষণা ও নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোতে চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করা এবং সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের জন্য একটি নতুন যুক্তরাজ্য-ইইউ নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের পরিকল্পনা করছে লেবার পার্টি। এছাড়াও নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে তারা। যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের (ইসিএইচআর) সদস্য এবং ইউরোপীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভিত্তি গড়তে ন্যাটোর প্রতি তাদের অঙ্গীকার অটুট থাকবে। তারা ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাজ্যের সামরিক, আর্থিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ পাইয়ে দেওয়ার পথ সুগম করতে তাদের সহায়তার বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে।


নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ন্যাটো, জাতিসংঘ, জি-৭, জি-২০ ও অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, শক্তিশালী করা ও সংস্কারে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে লেবার সরকারের। তারা ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় ‘অকাস’ নিরাপত্তা অংশীদারত্ব চুক্তিতে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের কাছে তাৎক্ষণিক গুরুত্ব পাবে। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, সব জিম্মির মুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখা এবং ওই অঞ্চলে দ্রুত সহায়তা বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে যাবে লেবার সরকার। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে একটি ‘নতুন শান্তি প্রক্রিয়ার অবদান’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকেই যাবে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অখণ্ড অধিকার’ হিসাবে বর্ণনা করেছে লেবার পার্টি। তাদের ভাষ্য-ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য এটি অনিবার্য। বিবৃতিতে লেবার পার্টি যুক্তরাষ্ট্রকে অপরিহার্য মিত্র হিসাবে উল্লেখ করেছে। নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য উভয় দেশের বিশেষ সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দাসহ অভিন্ন মূল্যবোধ ও স্বার্থের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য আমেরিকার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us