উন্নয়ন অর্থনীতিতে চারটি দেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামে অভিহিত করা হয়: সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা ভিয়েতনামকে এরই মধ্যে ‘দ্য নেক্সট এশিয়ান টাইগার’ আখ্যায়িত করা শুরু করায় দেশটির অর্থনীতি সম্পর্কে কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণ বক্ষ্যমাণ কলামে তুলে ধরছি বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে হাইলাইট করে। প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামকে অনেক উন্নয়ন-চিন্তক ভবিষ্যতের জাপান হিসেবে বিবেচনা করছেন। ভিয়েতনাম প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে ১৯৭৫ সালে, বাংলাদেশের চার বছর পর। তিন দশকের চরম বিধ্বংসী স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে ওই সময় ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো, যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান ছিল ৭৫ শতাংশ জনগণের। বিশ্বের জনগণের কাছে ভিয়েতনাম হলো সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরানো স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ী দেশ। সমাজতন্ত্রী ভিয়েতনাম বিশ্বের একমাত্র দেশ যে দেশটি বিশ্বের দুই-দুটি সুপার পাওয়ার ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে, ফ্রান্স পরাজয় বরণ করেছে ১৯৫৪ সালে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৫ সালে। বাংলাদেশকেও স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শাহাদতের মূল্য চুকিয়ে এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে বিজয় অর্জন করতে হয়েছে। বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে, যেখানে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আমাদের দুটো দেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাস চিরদিন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল তখন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এ অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ভিয়েতনামের বীর জনগণের ক্ষেত্রে। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য স্বাধীন ভিয়েতনামকে মার্কিনিরা অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পঙ্গু রাখারও ব্যবস্থা করেছে দুই দশক। এ সত্ত্বেও ভিয়েতনাম কখনই কোনো দেশের কাছে মাথা নত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি। এমনকি অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি। অথচ কী দারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোয় ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার (বাংলাদেশের চেয়ে কম), ১৯৮৫ সালে ছিল ২৮৫ ডলার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ পরের ৩৯ বছরে ভিয়েতনাম প্রবৃদ্ধির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ২০০০ সালে ভিয়েতনামের জিডিপি ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে ৪৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ৪ হাজার ৩১৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটাকে ‘মিরাকল’ আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পারচেইজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ২০২২ সালে পৌঁছে গেছে ১২ হাজার ৮১০ পিপিপি ডলারে। ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল; এক দশক ধরে তা ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৭৫ সালে যেখানে ভিয়েতনামের ৭৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে উন্নয়ন অর্জনের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ২ শতাংশেরও কম জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামের মানব উন্নয়ন সূচক ছিল দশমিক ৭৮, যেখানে বাংলাদেশের সূচক এখনো দশমিক ৬৭। ২০২২ সালের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল ১০৭ নম্বরে, বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯ নম্বরে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামের সাক্ষরতার হার ছিল ৯৬ শতাংশ আর বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ।