বাংলাদেশের অন্যতম মশা গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। মশা নিয়ে জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্স’ (জেএসপিএস) পদক পেয়েছেন। বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতি, এর মোকাবিলা ও সতর্কতা এবং আগাম প্রস্তুতির বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকা।
এবার বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেমন হতে পারে?
ড. কবিরুল বাশার: আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার এডিস মশা নিয়ে গবেষণা করছি। শুধু ঢাকা নয়, এর বাইরেও আমরা কাজ করছি। যেমন চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, গাজীপুর, চাঁদপুর, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ। শুধু ঢাকা নয়, বাইরেও এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। মাঠপর্যায়ে ডেঙ্গুর বাহক মশার যে ঘনত্ব পাচ্ছি, অন্যান্য বছরের তুলনায় তা বেশি। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এ বছর ডেঙ্গু রোগীর ও এডিস মশা বাড়ার সংখ্যা গতবারের তুলনায় বেশি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ২০২৩ সালে। সরকারি হিসাবে, এক বছরে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হওয়ার পর থেকে এটাই সর্বোচ্চ আক্রান্ত। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আমরা বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবং এডিস মশার ঘনত্ব—এ কয়েকটি প্যারামিটার দিয়ে মাল্টিভেরিয়েন্ট অ্যানালাইসিস করে যে ফোর কাস্টিং মডেল তৈরি করি, তাতে দেখা যাচ্ছে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে।
একসময় ডেঙ্গু পরিস্থিতি শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী?
ড. কবিরুল বাশার: এখন গ্রামগুলো আর সেই অর্থে গ্রাম নেই। সব গ্রামই কম-বেশি নগরায়ণ হয়েছে। যখনই অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয় এবং নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ না থাকে, তখন মানুষ বালতিসহ বিভিন্ন জায়গায় পানি জমিয়ে রাখে আর এই জমানো পানিতে এডিস মশার প্রজনন হয়। এডিস মশা এক শহর থেকে আরেক শহর বা গ্রামে বাস, স্টিমারসহ বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই জায়গায় যদি তারা প্রজননের পাত্র পায়, তাহলে এর বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি কেন?
ড. কবিরুল বাশার: আসলে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহ সংক্রমণ শুরু হলেও সেই সময় একে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাটা পর্যাপ্ত ছিল না। এখন গবেষণা হচ্ছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল যদি সঠিকভাবে ব্যবহার ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একটা কেবি মডেল প্রস্তাব করেছি। এই মডেল নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ ও ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। এই মডেল যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আপনার প্রস্তাবিত মডেলের বিষয়ে জানতে চাই।
ড. কবিরুল বাশার: পদ্ধতিটা যদি আমি সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করি তাহলে দাঁড়ায়, একজন স্বাস্থ্যকর্মী বা একজন কীটতত্ত্ববিদ যিনি মশা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তিনি কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেবেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্মীর অধীনে ১ হাজার বাড়ি থাকবে। তিনি নিয়মিত সেসব ভিজিট করবেন। সেই বাড়িতে যদি এডিস মশা পাওয়া যায়, সেই মশার পাত্রগুলো ধ্বংস করবেন। যে পাত্রগুলো ধ্বংস করা যাবে না, সেগুলোয় কীটনাশক প্রয়োগ করবেন। এটি তিনি নিয়মিত, মানে ১৫ দিন অন্তর করবেন। তিনি প্রতি বাড়ি ভিজিট করবেন এবং এই ভিজিট রেকর্ড সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবেন। এভাবে আমরা যদি কোনো পুরো শহরে কাজ করতে পারি, তাহলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকবে। কোনো বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে ক্রাশ প্রোগ্রাম করে উড়ন্ত মশা মেরে দেবেন, যাতে সেই বাড়ির মশা নতুনভাবে আক্রমণ করতে না পারে। মডেলটি বিস্তারিত জানতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কবিরুল বাশারের প্রস্তাবিত মডেল দিয়ে গুগলে সার্চ করতে পারেন।
সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত কীটনাশক কতটা কার্যকর?
ড. কবিরুল বাশার: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যে তিনটি কীটনাশক ব্যবহার করে, যেমন মেলাথিয়ন, টেমিফস ও নোভালিওরন—আমি এগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি, এ তিনটি কীটনাশকই মশা মারার জন্য কার্যকরী। সেগুলো ল্যাবরেটরি পর্যায়ে কার্যকরী। তবে যে ফগিং বা ধোঁয়া দেওয়া হয়, সেটির ল্যাবরেটরি পর্যায়ে কার্যকারিতা থাকলেও মাঠপর্যায়ে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কার্যকারিতা কম।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যদি কীটনাশক কার্যকর হয়, তাহলে মশা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হলো, আপনার অস্ত্র যত ভালো থাকুক, যদি অস্ত্রটির ব্যবহার সঠিক সময়, সঠিক জায়গায় এবং সঠিক মাত্রায় না করা হয়, তাহলে সেটি ফলাফল না-ও দিতে পারে। এখন অস্ত্রটি সঠিক সময়, সঠিক জায়গায় এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহার হয়েছে কি না, সেটির মনিটরিং ও ইভাল্যুয়েশন হওয়া দরকার। তার রিপোর্টও থাকা দরকার। একটি প্রোগ্রামের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সেই প্রোগ্রামটি নতুন করে সাজাতে হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মূল্যায়ন প্রতিবেদন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজন হলে মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল প্রণয়ন করা যেতে পারে।