নির্বাচন গবেষণাকারীরা তাদের লেখনিতে গত তিনটি নির্বাচনের অগণতান্ত্রিক, নেতিবাচক ও দুর্নীতিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংশোধনী পাশ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর ক্ষমতাসীনদলীয় ব্যবস্থাপনায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে না। বিষয়টি যুগপৎ দেশে ও বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে। এ জন্য বহির্বিশ্বে দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন নির্বাচনগুলোয় ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর আনুকূল্য নিয়ে ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে পেরেছে। এ সরকারের অধীনে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পেরেছেন। তারা ভেবেছিলেন আমরা এ সরকারকে ক্ষমতায় এনেছি। সরকার আমাদের ওপর কৃতজ্ঞ থাকবে। এ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে আমাদের কেউ কিছু করতে পারবে না। এ জন্য নির্বাচন এলে এরা অব্যাহতভাবে সরকারি দলকে বিজয়ী করতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সহায়তা করেছেন। আর সরকার ক্ষমতাসীন হলে প্রতিদান হিসাবে এরা অবৈধভাবে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। মালিক বনেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি ও বাড়ির। নামে-বেনামে সম্পদ গড়ে এরা নিজেদের নিরাপদ ভেবেছেন। এরা নিজেদের এ সরকারের খুঁটি ভেবেছিলেন। তাদের কোনো ক্ষতি হলে এ সরকারের ভিত দুর্বল হবে এবং সরকার ভেঙে পড়বে বলে এসব দুর্নীতিবাজ আমলা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা ভাবতেন। এরা বিশ্বাস করতেন, যে সরকারকে তারা অবৈধভাবে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন, সে সরকারের অধীনে তারা নিরাপদে থাকতে পারবেন। কিন্তু রাজনীতির দাবা খেলা বড়ই জটিল। এ খেলায় অনেক সময় ছোটো ছোটো সৈন্য বড় বড় মন্ত্রী বা রাজাকে খেয়ে ফেলে কিস্তিমাত করতে পারে।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে এবং এ কারণে সরকার পতনের নমুনাও রয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোয় সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য দুর্নীতি বড় অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এসব দেশে গণসমর্থন বাড়াতে নির্বাচনি প্রচারণাকালে রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতিবাজদের প্রতি রক্তচক্ষু দেখায়। কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’, বা কেউ ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি ঘোষণা করে। তবে দুঃখের বিষয়, ওই দলগুলোই আবার সরকার গঠন করার পর দুর্নীতিবান্ধব হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এমন লক্ষণ দেখা যায়। গত তিন-চার দশকের রাজনীতি জরিপ করে দেখা যায়, প্রতিটি সরকারামলে কমবেশি দুর্নীতি চর্চা হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। বরং, সরকারের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজরা নামে ও বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছে। দেশের সম্পদ ও টাকা বিদেশে পাচার করেছে। দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশে, বিশেষ করে আমলা ও পুলিশ বাহিনীর অনেকেই এমন সম্পদের মালিক হয়ে নিজেদের নিরাপদ ভেবেছেন। ছোট দুর্নীতিকারী এবং বিরোধীদলীয় দুর্নীতিকারীরা অনেক সময় মামলার শিকার হলেও বড় দুর্নীতিকারী, বিশেষ করে সরকারি দলের সমর্থক দুর্নীতিকারী ও আমলারা অঘোষিত ছাড় পেয়ে সম্পদশালী হয়েছেন। গত ১৫-১৬ বছর ধরে অবৈধভাবে নির্বাচনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সরকারি দলকে নির্বাচনে জিততে সহায়তাকারী আমলা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন, তাদের শাস্তি হয়নি। তবে সম্প্রতি এ ধারায় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
কেন এ পরিবর্তন? সরকার কি নির্বাচনি বৈতরণী পার করানো উচ্চপদস্থ আমলাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছে? এ প্রশ্ন সবার। স্বাভাবিক চোখে দেখলে মনে হয়, সরকার ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’ নীতি অবলম্বন করেছে। কারণ, এ সরকারের সমর্থন না পেয়ে তো জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান হননি। সরকারি সমর্থন নিয়েই পুলিশপ্রধান বা র্যাবপ্রধানের পদে বসতে পেরেছিলেন বেনজীর আহমেদ। এরা তো নির্বাচনকালীন সরকারি দলকে বিজয়ী করাতে কার্পণ্য করেননি। পোশাকধারী বাহিনী ও আমলাদের সহায়তা নিয়েই সরকার গত নির্বাচনগুলো জিতে সরকার গঠন করেছে। সে ক্ষেত্রে তো সরকারের এসব দুর্নীতিবাজের ওপর খুশি থাকার কথা। তাহলে কী ঘটনা ঘটল যে, গত নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস পর ডোনাল্ড লুর সর্বশেষ ঢাকা সফরের কিছুদিন পর থেকে সরকার এর ঘনিষ্ঠভাজন আমলাদের দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচনে তোড়জোড় শুরু করল? লু ফিরে যাওয়ার পর সবাই ভাবছিলেন, কেন তিনি এলেন কিছুই বোঝা গেল না। তবে যাওয়ার সময় তার দেওয়া বক্তব্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আঁচ করতে পারেন, তিনি অকারণে ঢাকা সফর করেননি। তিনি দুর্নীতি বিষয়ে ঢাকা ও ওয়াশিংটন একত্রে কাজ করবে এমন কথা উচ্চারণ করেছিলেন। তার ওই বক্তব্যে অনুধাবন করা গিয়েছিল, তিনি হয়তো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।
আমেরিকা বললেই যে সরকারকে তা শুনতে হবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। নির্বাচনের আগে ইনক্লুসিভ নির্বাচন করার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে সরকারকে বারবার বলা হয়েছিল। সরকার তা আমলে নেয়নি। তাই আমেরিকার কথা না শোনায় ওয়াশিংটন যে সরকারের ওপর খুশি হয়েছিল, এমনটা ভাবার কারণ নেই। সে জন্য সরকার দুর্নীতি বিষয়ে কঠোর না হলে সরকারকে আমেরিকা অন্য কোনো গ্যাঁড়াকলে ফেলবে কিনা ভাবার কারণ আছে। তা না হলে সরকার যেসব দুর্নীতিবাজ আমলা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যদের এতদিন প্রশ্রয় দিয়েছিল, এখন তাদের দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচন করে নিজের বিপদ ডেকে আনছে কেন? নিজেদের ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতিকে সরকার এতদিন মিথ্যাচার, লোকদেখানো ও ভণ্ডামি প্রমাণিত করেছে। কারণ, সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া জেনারেল আজিজ, বেনজীর আহমেদ, আসাদুজ্জামান মিয়া, ড. শামসুজ্জোহা খন্দকার, মতিউর রহমান, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, মোহাম্মদ এনামুল হকসহ অনেক আমলা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ সঞ্চয় করতে পারেননি। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় সরকারের জনপ্রিয়তা কমে গেছে, এটা স্পষ্ট।
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে মৌখিক জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে কাজের বেলায় দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, প্রতি বছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ করে দিয়ে দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের পরোক্ষভাবে অধিকতর দুর্নীতি করতে সহায়তা করা হচ্ছে। এর ফলে দুর্নীতিবাজরা কালোটাকা সাদা করে সে টাকা দিয়ে সামাজিক মর্যাদা ক্রয় করে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে। রাতের টিভি টকশোতে এদের অনেকে আবার সুশাসনের ওপর বক্তব্য রাখছেন। এখানে ব্যক্তি সৎ না অসৎ, তা আমলে না নিয়ে তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের পরিমাপক হিসাবে দেখে তাকে সম্মান করা হয়। ফলে এমন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ পলিসি চলমান থাকলে দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে বাড়ে।