দেশে আত্মহত্যার হার বেড়েই চলেছে। মঙ্গলবারও রাজশাহীতে ফেসবুক লাইভে এসে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক কথাবার্তা চলছে। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অনেকেই বিভিন্ন তর্ক হাজির করেন; ব্যক্তিগত কলহ, প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবী ও সামাজিক মাধ্যমের কারণে মানবসম্পর্কের রূপান্তর, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, ব্যক্তিগত জীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক আলোচনায় পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক অনেকেই আত্মহত্যার কারণগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন। এই আলাপের দুর্বলতা হলো, কয়েক দশকে গড়ে তোলা সমাজ ব্যবস্থার সার্বিক রূপটি আমরা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা এমন একটি আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছি, যেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে গ্রাম কিংবা শহরে মানুষের টিকে থাকা এখন প্রায় যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, সেখানে হতাশা, ক্ষোভ বেড়ে যাওয়াটা পরিণতিমূলক ছিল।
দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে, হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা কম নেই। প্রতারণা অহরহ ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ছিনতাই, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চনাও কম নয়। লাখ লাখ মামলা ঝুলছে আদালতে, প্রতিবছর বেকারত্বের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারি অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষ বিনা কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছে। ব্যাংকে টাকা রেখেও স্বস্তি নেই। সমাজে নীতিহীনদের প্রভাব বেড়েই চলছে। চড়া দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষ হয়ে পড়ছে দিশেহারা। বিভিন্ন কারণে সমাজ এখন ভয়াবহ অস্থিরতায় নিমজ্জিত। এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। কেউ কেউ তাই হয়তো আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই হতাশা উপশম চান। ব্যক্তির হতাশা ধীরে ধীরে সমাজকেও অস্থির করে তুলছে। জীবনের অর্থ সংকুচিত হতে হতে তা নিজের চরিত্র হারাতে বসেছে।
নাগরিক জীবনে আরেকটি বহুল প্রচলিত শব্দ হলো ব্যস্ততা। ব্যাংক কর্মকর্তা তাঁর মক্কেল বাড়াতে, ডাক্তার তাঁর রোগীর তালিকা বাড়াতে, রাজনীতিবিদ তার ক্ষমতা বাড়াতে– সবাই সবার মতো ব্যস্ত। বিশেষত শহুরে সমাজকাঠামো এমনভাবে তৈরি, যেখানে ব্যস্ততাই নাগরিক জীবনের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যস্ততার এই সর্বব্যাপিতায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। অথচ সম্পর্কের জোরেই একটা সমাজ সজীব থাকে। কিন্তু এই নিষ্ঠুর সমাজকাঠামোয় প্রতিনিয়ত সম্পর্কগুলো হারিয়ে ফেলছে সজীবতা ও স্নিগ্ধতা। এমনকি আজকাল পিতার কাছে সন্তানের সঙ্গে দুই মিনিট মনভরে কথা বলার ফুরসত পাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা স্নেহ, ভালোবাসা, সহানুভূতি, দয়ামায়াহীন এমন একটা সমাজ নির্মাণ করেছি, যেখানে সম্পর্কগুলো প্রতিনিয়ত ক্লিশে হয়ে পড়েছে। নাগরিক জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের কারণে সম্পর্ক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
মানবজীবনের এই কঠিন বাস্তবতায় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ছে। অবিশ্বাসের রাজ্যে একজন রিকশাওয়ালা ও অফিসফেরত পেশাজীবী কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবাই দরকষাকষি ও ধূর্ততার মাধ্যমে অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার চিন্তায় মশগুল। নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত এই সমাজে সততাকে এখন বোকাদের বৈশিষ্ট্য বলে দেখা হয়। এই ছলচাতুরিপূর্ণ সম্পর্কের কারণে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই তিক্ততা বেড়ে চলেছে।
গত কয়েক দশকে সহিংসতার হার ও ধরনও বেড়ে গেছে। ক’দিন আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে। কক্সবাজারে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামী ও স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। সামান্য কয়েকশ টাকার জন্য মানুষ খুন করার ঘটনা ঘটছে। তুচ্ছ ঘটনার জেরে মানুষ সহজেই সহিংসতার পথ বেছে নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি প্রতি অনাস্থা থেকে জনসাধারণের মধ্যে নিজের হাতেই আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
একরৈখিক চিন্তা এতই প্রভাব বিস্তার করছে যে, ভিন্ন মতাবলম্বী হলেই শাস্তি ও কোণঠাসা করে দেওয়াটা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের চিন্তা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি। এই রাজনৈতিক চর্চায় সমাজে প্রথমে ‘পক্ষ-বিপক্ষ’ এবং পরে ‘পরস্পর প্রতিপক্ষ’ রাজনীতির সূচনা ঘটছে।
আত্মহত্যার ঘটনা স্রেফ ব্যক্তিগত যেমন নয়, তেমনি সমাজবহির্ভূতও নয়। সমাজের মধ্যে গেড়ে বসা অস্থিতিশীলতা, কলহ, ব্যক্তিগত অস্থিরতা, পারিবারিক আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, চরম বৈষম্য, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন কীভাবে ফিরে আসবে, সেটা আমাদের জানা নেই; বাড়ির বাইরে গিয়ে পরিবারের একজন নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে কিনা, সেটাও আমরা নিশ্চিত নই। স্রেফ পুঁজি ও মুনাফানির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোতে কর্মজীবীরা শ্রমের সঠিক মূল্য পাবে কিনা, তাও এখন দুরাশা। তাহলে এ সমাজে আত্মহত্যা কীভাবে ঠেকানো যাবে– এখন সেটাই প্রশ্ন।