প্রাচীন কোনো যুদ্ধের ছবি, তা কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা অথবা চলচ্চিত্র হোক না কেন, আমরা দেখতে পাই শিশু, নারী ও প্রবীণদের অসহায় আর্তি। আজও দেশে দেশে যখন শত্রুর আক্রমণ হয়, তখনো একই চিত্র। ইরাক যুদ্ধে, ইউক্রেন যুদ্ধেও অসহায় শিশু, নারী, বৃদ্ধদের ছবি বারবার সভ্য মানুষ ও মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এবার গাজার যুদ্ধে অসংখ্য শিশুর রক্তাক্ত দেহও আমরা দেখেছি এবং বারবার প্রশ্ন করেছি—এই সভ্যতার মূল্য কোথায়?
কিন্তু এটাও ঠিক, কিছু কিছু দেশে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য প্রবল আন্দোলন চলছে। কোনো কোনো সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এগিয়েও আসছে। নতুন আইনও প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন, সে এক বিরাট প্রশ্ন। আবারও সামাজিক নিরাপত্তার কথা আসে। সমাজে যদি বড় অসাম্য তৈরি হয়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? ভয়াবহ দারিদ্র্য যেখানে একটা প্রান্তিক সমাজ নির্মাণ করছে, সেখানে শিশুশ্রম বন্ধ হবে কীভাবে? আর যেখানে বৈষম্য দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
এখন সমস্যা হচ্ছে প্রবীণদের নিয়ে। একটা বয়স পার হওয়ার পর প্রবীণদের নানা শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে থাকে। তারুণ্য অতিক্রম হওয়ার পর থেকেই চোখের সমস্যা শুরু হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুদেরই চশমা পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। একবার একটা আন্তস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়েছিলাম। স্কুলগুলো বড়লোকদের ইংরেজি স্কুল। ছেলেগুলোর কেউ কেউ বেশ হৃষ্টপুষ্ট, কিন্তু চোখে চশমা। ২২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৬ জনেরই চোখে চশমা। কারও কারও বেশ পুরু চশমা। প্রবীণদের ক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। একটা বয়সে চোখে ছানি পড়বেই, যতই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোন না কেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই রোগের চিকিৎসা একেবারেই অপ্রতুল। বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও চক্ষু চিকিৎসকবৃন্দ বিনা মূল্যে এই রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। যেহেতু এই চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার ও লেন্স লাগে, সে জন্য বিষয়টি ব্যয়সাপেক্ষ।
সম্প্রতি আমি বাংলাদেশের একটি প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ে গিয়েছিলাম এমনই এক চক্ষুশিবিরে। বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তির অনুদান, সহযোগী কিছু সংস্থার যৌথ উদ্যোগে শিবিরটি পরিচালিত হয়েছে। এই জেলায় এমনিতেই চিকিৎসাব্যবস্থা একেবারে অপ্রতুল, তার ওপর এই শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রমও সহজ নয়। ‘রিক’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের আরও একটি কার্যক্রম আছে, তা হলো প্রবীণদের জন্য।
পশ্চিমা দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই প্রবীণদের জন্য ‘ওল্ড মেন’স হোম’-এর কার্যক্রম চলছে। সেখানে প্রবীণদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। পশ্চিমা আদলে এ দেশেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠছিল, কিন্তু সেগুলো একেবারেই কার্যকর হয়নি। কারণটা সাংস্কৃতিক। বহু শতাব্দী ধরেই প্রবীণেরা পরিবারের সঙ্গে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রতিটি পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বসবাস করে থাকেন। তাদের জীবনের আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একাকার হয়ে থাকার মধ্যেই তাঁদের দিন যাপন। অসুখ-বিসুখে তাঁরা সে জন্যই অসহায় বোধ করেন না। বিত্তহীনদের মধ্যে অবশ্য বৃদ্ধ বাবা-মা একপর্যায়ে বোঝা হয়ে গেলেও সন্তানেরা কখনোই তাঁদের ত্যাগ করতে চান না। কখনো হয়তো অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় ওই বিপন্ন বৃদ্ধদের মৃত্যু ঘটে থাকে। যাঁরা বিত্তবান তাঁদের জন্যও বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে। সেগুলোতে একটা বিলাসী জীবন হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু ওই বৃদ্ধ বাবা কিংবা মা অথবা দুজনেই স্বজনদের স্পর্শহীন হয়ে বেদনায় দিন কাটান।