বাংলাদেশ বেশ লম্বা সময় যাবৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করে আসছে। একটি দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৫৯) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪, ৬৫>) অতিক্রম করে, তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের উদ্ভব হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফলে দেশের কর্মক্ষম তরুণ শক্তিশালী জনগোষ্ঠী কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন খাতে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে যুব শ্রমশক্তির (১৫-২৯ বছর বয়সী) সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখের বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের এই বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (১৫-২৪ বছর বয়সী) প্রায় ৩৯.৮৮ শতাংশ বর্তমানে কোনো কর্মে নিয়োজিত নেই।
নারীদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত না থাকার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের জনগণ যখন মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তরুণদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, দেশের শ্রমবাজারের তাদের অংশগ্রহণ না থাকা অর্থনীতির জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনে না।
এই সংকট আরও গভীরতর হয় যখন দেখা যায়, চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে আগ্রহী শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ উচ্চশিক্ষা শেষ করার পরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে অনুপযুক্ত ও কম মজুরির কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায়, বেকারত্ব শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং জাতীয় উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দিচ্ছে।
নির্বাচিত সরকারের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘স্মার্ট বাংলাদেশ উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। নির্বাচনের পরে নতুন বাজেট যখন ঘোষণা করা হলো, তখন দেশের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক বেকারত্বের হার প্রায় ৩.৫১ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ৬ জুন ২০২৪ মাননীয় অর্থমন্ত্রী সংসদে ৫৪তম বাজেট ঘোষণা করলেন।
এবারের বাজেটের আকার গত বছর থেকে প্রায় ৪.৬ শতাংশ বেড়ে ৭, ৯৭, ০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারের বাজেটেও দেশের সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম গোষ্ঠী তরুণদের কর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দক্ষতা উন্নয়নে কতটা লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ কীভাবে নিলেন, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
তরুণদের মধ্যে প্রায়ই যে কথা আলোচনা করতে দেখা যায় যে, দেশের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই এবং সঠিক শিক্ষার পরিবেশ নেই। এই বাজেটে যেসব ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’। সেই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত প্রয়োজন।
শিক্ষাখাতের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী সব মিলিয়ে প্রায় ৯৪, ৭১১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২৭ শতাংশের কাছাকাছি। বাজেট বৃদ্ধি পেলেও তা এখনো জিডিপির ২ শতাংশের নিচে রয়েছে।
বাজেটে উল্লিখিত ‘তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিক্ষাখাত এখনো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা মেটানোর মতো কারিগরি দক্ষতা জনগণের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শুধুমাত্র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না, বরং তা সঠিকরূপে পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তরুণদের মধ্যে যুগোপযোগী বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করাও জরুরি।