শিশুশ্রম বা শিশুদের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সুশাসন পরিস্থিতি সবকিছুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার আলোচনায় তার কয়েকটি বিষয়ে জোর দেয়া হবে। শুরুতে ২০১৩ ও ২০২২ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশুশ্রম জরিপ থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক।
বিবিএসের এই দুটি জরিপ একই সংজ্ঞা ব্যবহার এবং ৫-১৭ বছর বয়সীদের এ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ ও ২০২২ সালে উপার্জন কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৪ ও ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন। এই বয়সী মোট শিশুর মধ্যে শ্রমজীবী শিশুর অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ৭ এবং ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ এই অনুপাত সামান্য বেড়েছে। আর মোট সংখ্যাও কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে।
বিবিএসের জরিপগুলো আরো একটি তথ্য দিয়েছে, যা ‘শিশুশ্রম’ বিষয়ক। শ্রমঘণ্টা ও কাজের ধরনের ভিত্তিতে যেগুলো শিশুর জন্য সরাসরি ক্ষতিকর, তেমন কাজে নিয়োজিতদের এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিশু শ্রমিকদের অংশ ছিল ২০১৩ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩ ও ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
অর্থাৎ সরকারি জরিপ থেকেই দেখা যাচ্ছে সার্বিকভাবেই শিশুদের উপার্জন কাজে নিয়োজন বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কারণ যে বয়সে তাদের স্কুলের পড়াশোনায় আনন্দে দিন যাপনের কথা সে বয়সে কর্ম নিয়োজন তাদের মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের বঞ্চনার আরেকটি দিক হচ্ছে শিক্ষা সমাপ্ত না করায় ভবিষ্যতে তারা শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি হিসেবে উন্নত মানের কর্ম নিয়োজনে যেতে পারবে না। এতে দেশ তাদের সম্ভাব্য অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উদ্যোক্তরা কেন শিশুশ্রম নিয়োগ করছে, অর্থাৎ চাহিদার দিকে কী ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করছে, সেটি এবার দেখা যাক। উদ্যোক্তরা অবশ্যই এটা সুবিধাজনক মনে করছে। তার কারণ তাদের মজুরি বা মাসিক বেতন প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম। শুধু তাই নয়, তাদেরকে দিয়ে নির্দেশ পালন করানো বা কথা ‘শোনানো’ সহজ। তবে বিষয়টি এভাবে দেখার কারণ হচ্ছে এদেশে শ্রমবাজারে নিয়োগ দেয়া হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে। সেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরো প্রকট। এমনকি শিশুর উপার্জন কাজের সঙ্গে যখন শিক্ষা অর্জনের সমন্বয় কঠিন হয়, তখন শিক্ষার বিষয়টি বাদ পড়ে।
অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তাদের বরং মনোভাব এই যে দরিদ্র পরিবারের শিশুকে নিয়োগ করলে পরিবারকে সাহায্য বা আনুকূল্য করা হলো। উপার্জনকাজে শিশুর নিয়োজনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সমাজে যথেষ্ট সচেতনতার অভাব আছে। তাই এভাবে চিন্তা করা হয়। সে সঙ্গে শিশু যখন এরই মধ্যে স্কুল থেকে বাদ পড়েছে, শিশুর অভিভাবক যখন শিশুর ‘অসামাজিক’ পথে যাওয়া বা বাজে বাজে কাজে সময় ব্যয় করা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তখন নিয়োগকারীর পক্ষে তাকে কাজে নিয়োজন করাটা উত্তম পথ মনে করাটা অযৌক্তিক নয় অর্থাৎ স্কুল থেকে ঝরে পড়াটাই মূল গলদ।