অর্থনীতি ও বাজেট আমি তেমন বুঝি না। বাজেট পেশ হয়ে গেলে বুঝতে পারি, যখন টিভিতে, খবরের কাগজে দেখি সরকারপক্ষ বলতে থাকে, এটি গণমুখী বাজেট আর বিরোধীপক্ষ বলতে থাকে মানুষ মারার বাজেট, লুটপাটের বাজেট। এই সঙ্গে এখন সক্রিয় থাকে দু-একটি এনজিও সংস্থা, যারা অর্থনীতির নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে সাধারণত বাজেটের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে। বাজেটে ছিটেফোঁটা হলেও কোনো ভালো দিক যে আছে, তা তাদের প্রতিক্রিয়া শুনে বোঝার উপায় নেই। তবে এসব নিয়ে আমি বেশি মাথা ঘামাই না। অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আমার তেমন আগ্রহও নেই। সাধারণভাবে বেঁচেবর্তে থাকতে পারলেই চলে। ব্যাংকে কত টাকা জমা আছে বা জমা হলো, এসব খুব জটিল ও অপ্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়। ‘সরল জীবনেই শান্তি’-এই চিরকালীন দর্শনে আমি বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে এর পক্ষে উদাহরণও পাই। যেমন শুনে থাকি, এদেশের ‘বড় মানুষেরা’ অনেকে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি বিবেচনা করে তা আর ফেরত দেন না। এজন্য কখনো তাদের মর্মযাতনা হয় কিনা আমরা জানি না। আবার এ কথাও শুনি, নানা প্রভাব খাটিয়ে ধনীরা আরও ধনী হওয়ার লোভে জনগণের টাকা নিজের মনে করে পাচার করে দেন বিদেশে। তখন বুঝতে পারি বাইরের চেহারা যাই হোক, অন্তরে তাদেরও চৌর্যবৃত্তির জন্য মর্মযাতনা থাকে। অবৈধ টাকার গদিতে বসে এসব ভদ্র মুখোশের চোররা কি মনের দিক থেকে ভালো থাকে? ধরে নিচ্ছি, সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের ভাষ্যে কিছুদিন আগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সদ্য সাবেক পুলিশপ্রধান বিশাল সমুদ্র চুরির নজির স্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রশক্তির কাছাকাছি থেকে বাংলাদেশেই শত শত একর ভূ-সম্পত্তির মালিক হলেন। নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট-এসবের মালিক ও অংশীদার হয়ে গেলেন। এতই আলাদিনের চেরাগ হাতে ছিল যে, একদিনেই গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় চারটি ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন।
একটি মানুষের কতটা চাই! মনোবিজ্ঞানীরা হলে হয়তো বলতেন, এসব এক ধরনের মানসিক রোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হলো! উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার সব সম্পত্তি শুধু ক্রোকই হলো না, আদালতের নির্দেশে সেসব সম্পত্তির জন্য তত্ত্বাবধায়কও নিয়োগ দেওয়া হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে সব চলে এলো। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে পালানোর আগেই সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে হয়তো নানা এজেন্সির গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ব্যাংক খালি করে দিয়ে একগাদা টাকা অবৈধপথে পাঠিয়ে দিলেন নিরাপদে। শেষ পর্যন্ত এসব অর্থের কতটা ভোগ করতে পারবেন কিছুই বলা যাচ্ছে না।
তাহলে বেলাশেষে বেনজীর আহমেদের হাতে কী রইল? যদি বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের কাছে একজন বড় দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত থাকবেন। এতে হয়তো বেনজীরদের মতো মানুষের খুব বড় প্রতিক্রিয়া হবে না। ওই যে কথায় আছে, এক কান কাটা গেলে লজ্জায় মুখ লুকায় আর দুকান কাটা গেলে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। বেনজীরও হয়তো বুক ফুলিয়ে হাঁটবেন। কিন্তু স্ত্রী, কন্যা ও পরিবার-পরিজনদের কী হবে! তারা বৃহত্তর পরিবার, সমাজ সংসারের কাছে মুখ দেখাবেন কেমন করে! লজ্জা ও বিপদ এড়াতে না হয় পালিয়ে দেশান্তরী হলেন। তাতে কী লাভ হলো! বেনজীর ও তার পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি তো তাকে আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি দিয়েছে। যেখানেই যাবেন সেখানে অন্তত বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে দেখা হবে। তারা স্বাভাবিকভাবে তাকালেও স্ত্রী-কন্যাদের মনে হবে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সবাই। এর চেয়ে মর্মবেদনা আর কী হতে পারে! স্বাভাবিক মানবিক চেতনার মানুষ হলে তো মনে হবে ধরণী দ্বিধা হও!
মানুষ অন্যায় করার সময় সম্ভবত এতসব হিসাব করে না। আবার এটিও ঠিক, দুর্নীতির সম্পদ সবাই সমানভাবে হজম করতে পারে না। আর অন্যায়কারীর আশ্রয়দাতা এবং সহযোগীরাও কি খুব স্বস্তিতে থাকতে পারছে! সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় সরকারি এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহযোগিতা, ভরসা এবং ভাগবাঁটোয়ারা ছাড়া বেনজীর সাম্রাজ্য গড়তে পারতেন না। দায়িত্বপূর্ণ পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে বছরের পর বছর এত বড় দুর্নীতির ফিরিস্তি সংশ্লিষ্ট যাদের জানার কথা, তারা জানতেন না বললে মানুষ মানবে কেন! সাধারণ মানুষ তো এখন বলাবলি করছে বেনজীর দেশের ভেতর থাকলে ঝুলি থেকে অনেকের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে যাবে বলে তাকে আড়াল করা হয়েছে। অনেকের স্বার্থ এভাবে ঠিক রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেনজীরকে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যেসব সুবিধা পেয়েছে দলটি, এখন হিসাব করলে হয়তো দেখতে পাবে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারচেয়েও বেশি। নানা দিক থেকেই মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা হারাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী দলটি। এমন অবস্থায়ই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর অভাব অন্য কোনোভাবে পূরণ করা কঠিন।