জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফ্রাঞ্চেসকা আলবানিজের ‘অ্যানাটমি অব এ জেনোসাইড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত ২৬ মার্চ প্রকাশ হয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি-বিষয়ক জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত তাঁর প্রতিবেদনে বলেছিলেন, হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর পর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেখানে হাজার হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রাণ হারিয়েছে।
অন্যদিকে জ্বলছে ইউক্রেন। রুশ ও ইউক্রেন সৈন্য এবং সাধারণ জনগণসমেত প্রায় পাঁচ লাখ প্রাণহানি ঘটেছে দুই বছরের এই যুদ্ধে। সেখানেও রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছে ইউক্রেন সমর্থক পশ্চিমা বিশ্ব। ‘আধুনিক’ বিশ্বে গণহত্যা বিষয়ে আলোচনা, নথিপত্র, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কম নেই। কিন্তু এটা যে সুযোগ পেলেই সংঘটিত হতে পারে, গাজা ও ইউক্রেন পরিস্থিতি এর প্রমাণ।
পোলিশ এক ইহুদি রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে প্রথম ‘জেনোসাইড’ প্রতিশব্দটি প্রণয়ন করেন এবং ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের আর্টিকেল-২ গণহত্যার সংজ্ঞা প্রবর্তন করে। এই সংজ্ঞানুযায়ী, কোনো একটি গোষ্ঠীর মানুষকে নির্দিষ্টভাবে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কৃত যে কোনো পদক্ষেপ জেনোসাইডের আওতায় পড়ে। একাত্তরের গণহত্যার কথা ভাবলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার ছবি ফুটে উঠতে বেগ পেতে হয় না। ৩০ লাখ মানুষকে প্রায় প্রতিরোধহীন অবস্থায় হত্যা এবং রাজাকারদের এতে ইন্ধন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যায়ের সর্বনিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের আদি গণহত্যার নজির মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯ সালে, যখন তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে রোমানরা কার্থেজ নগরী ধ্বংস করেছিল আর নির্বিচারে হত্যা করেছিল সহস্র ফিনিশিয়ান। গত দুই সহস্রাব্দে গণহত্যার নির্মমতা ও পৌনঃপুনিকতা দুইই বেড়েছে। ইহুদি-রোমান যুদ্ধ থেকে আরবদের সীমানা বিস্তৃতি, ভাইকিংদের সম্প্রসারণ, ক্রুসেড, চেঙ্গিস খানের মঙ্গোলিয়ার বিস্তার, স্পানিয়ার্ডদের আমেরিকা দখল লাখে লাখে প্রাণক্ষয়ের নজির রেখে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসীদের লাখে লাখে হত্যা করেছে মার্কিন সরকার, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের তিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী– তালাত পাশা, এনভার পাশা ও জামেল পাশা আতাতুর্কের আদেশে প্রায় ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার মতোই বুদ্ধিজীবী, পেশিশক্তিসম্পন্ন পুরুষদের হত্যা এবং শেষে নারী ও শিশুদের সিরীয় মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হত্যা করে অটোমান তুর্কিরা। ১৯৩২-৩৩ সালে রুশরা ইউক্রেনে আর ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশরা বাংলায় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে হত্যা করে লাখো মানুষকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি নিধন, ১৯৬৫-৬৬তে ইন্দোনেশিয়াতে সম্পাদিত সমাজতন্ত্রীদের হত্যা, বাংলাদেশের গণহত্যা, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়ার নিধনযজ্ঞ মানব চরিত্রের নির্মমতার ছবি তুলে ধরে।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরও এর আইন অমান্য হতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৯৪ সালে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ৮ লাখ তুতসি হত্যা করে রুয়ান্ডার সংখ্যাগুরু হুতু গোষ্ঠী। ১৯৯৮ সালে মিলোসেভিচের নির্দেশে সার্বীয় বাহিনী প্রায় ৯০০০ কসোভো আলবেনীয়র ওপর চালায় গণহত্যা। এমন নির্মম ও বর্বরোচিত আচরণ কোন মানবতার ইঙ্গিত বহন করে? মানুষ কি তবে মানবতাহীন?
বস্তুত গত তিন শতকে মানব হত্যার হার যেন বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। ১৭ শতকের চেয়ে ১৮ শতকে প্রাণনাশ দ্বিগুণ হয়েছে, ১৯ শতকে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ গুণ! গত ১০০ বছরে গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ছয় কোটি মানুষ! এই সংখ্যা প্রতিটি মানুষের বিবেক কাঁপিয়ে দেওয়ার কথা। মানুষ কী করে এত মানুষকে একাধারে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে!
মার্কিন সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ জেমস ওয়ালার ‘বিকামিং ইভিল’ গ্রন্থে গণহত্যার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মতাদর্শিক, ধর্মীয় বা দলগত অধিভুক্তি ও আনুগত্য, আবার কখনওবা জাতীয়তাবাদ বা কোনো নেতার প্রতি অন্ধত্ব বদলে দেয় মানুষকে। সাধারণ আটপৌরে জীবন ধারণে অভ্যস্ত মানুষ, ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনা ভুলে কিছু পার্থিব বা অপার্থিব তথাকথিত ‘আদর্শের’ টানে মানব নিধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে ওয়ালার দেখাচ্ছেন যে যখনই মানুষ নিজের গোষ্ঠীর মানুষ, গোত্রের মানুষ, ধর্মের মানুষ, দেশের মানুষ থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে আরেকটি গোষ্ঠী, গোত্র, ধর্ম বা দেশের মানুষকে, তখনই গণহত্যা সম্ভব হয়। সঙ্গে মোড়ক হিসেবে বা মানসিক বর্ম হিসেবে কাজ করে নিজ গোষ্ঠী বা গোত্রের প্রতি আনুগত্য।