আশা করা হয়েছিল নতুন অর্থমন্ত্রী তাঁর অধীত শিক্ষার প্রয়োগ ঘটাবেন এই বাজেটে। তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ও কূটনীতির মানুষ। কিন্তু তিনি কোনো নতুনত্ব দেখাতে পারলেন না। আগের অর্থমন্ত্রী যে যে ভুল করে বাজেটকে বেপরোয়া বানিয়ে গেছেন, তা থেকে এই অসহায় কাঠামোকে উদ্ধার করতে পারলেন না। আগের অর্থমন্ত্রী হিসাববিদ ছিলেন। তাঁর কাজকর্মে অর্থনীতির নামগন্ধ ছিল না। যদিও তিনি মাঝেমধ্যে অর্থনীতির নতুন নতুন তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
যেমন সুদের টুপিতত্ত্ব ও রেমিট্যান্সের প্রণোদনাতত্ত্ব—কোনোটিই কাজে আসেনি। বরং ক্ষতি করেছে। কাজের সীমারেখা বুঝতেন না বলে খেলাপি ঋণের বিশ্ব-শিথিল নব সংজ্ঞায়ন করে পুরো ব্যাংকিং খাতকে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন। আজকের অর্থনীতির সংকটের পেছনে তাঁর ‘অসামান্য কৃতিত্ব’ রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, নতুন অর্থমন্ত্রী আগের মতো ভুল গিয়ারে গাড়ি চালাবেন না, যা সরকারকে আরও খাদে নিয়ে নামাবে।
বাজেটকে বিরোধী দল ‘গণবিরোধী’ বলবে আর সরকারি দল বলবে ‘চমৎকার’—এ সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু অসংগত দাবি অস্বস্তিকর বটে। আয়বৈষম্যের প্রকট উত্থান সত্ত্বেও সরকারি দলের একজন বললেন এটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের বাজেট।
দু–একজন নেতা বললেন যে বর্তমান ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির’ তুলনায় এ বাজেট অনেক ভালো হয়েছে। বিশ্বের কোথায় পরিস্থিতি খারাপ, সেটা বোঝা গেল না। সবাই তো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ফেলেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশেও। ওদের রিজার্ভও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক বড় অর্থনীতিতে বেকারত্ব অনেক কম। কারও জন্য এটি রেকর্ড। বৈশ্বিক তেল ও পণ্যের দামও পুতিন-তাড়িত যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় চলে গেছে। কোভিড, পুতিন, যুদ্ধ—এগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক আলাপ।
কথা ছিল বাজেট হবে সংকোচনমূলক। এই মুহূর্তে সংকোচনমূলক হওয়া আবশ্যক ছিল। তা না হলে মাসখানেক পর ঘোষিতব্য মুদ্রানীতি একা সংকোচনমূলক হয়ে কাজ করতে পারবে না। গাড়ির গতি কমাতে গেলে এর ব্রেক সিস্টেম যদি সব কটি চাকার ওপর একসঙ্গে কাজ না করে, তাহলে যথাস্থানে গাড়ি থামানো যায় না। গাড়ি উল্টে যায়। আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির দহন সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে যেভাবে যাতনা দিচ্ছে, তার দীর্ঘায়ুর পেছনে একটা বড় কারণ বাজেট ও মুদ্রানীতি কখনোই যৌথভাবে সংকোচনমুখী হয়নি।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে ঠিক করতে হলে ওষুধ ও পথ্য—দুই পথেই সহগামী ও সংগতিপূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একদিকে ওষুধ খেয়ে অন্যদিকে কোলেস্টেরলবর্ধক খাসির তেল আর বেশি বেশি লবণ খেলে রক্তচাপের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের গত তিন বছরের নীতি প্রণয়নের ইতিহাস মানে এই খাসির তেল আর ওষুধের যুগপৎ অগ্রযাত্রা, যা মূল্যস্ফীতিকে উচ্চ স্থানে ধরে রেখেছে। এবারের বাজেট সংযত হওয়ার কোনো পদক্ষেপ দেখায়নি। তাই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো ভরসাও এ থেকে লাভ করা যায়নি।