স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে এক অসাধারণ অবস্থান নিয়ে আছে। ভারতীয় জাতীয়তা এবং ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তার বিপরীতে নৃতাত্ত্বিকভাবে একক জাতিসত্তার স্বতন্ত্র জাতীয়তার বিকাশ; এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ ধরে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যান্য উপনিবেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ থেকে স্বতন্ত্র ও অনন্য। ইতিহাস জানান দেয়-এশিয়াসহ বিশ্ব উপনিবেশসমূহের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রায় অভিন্ন। এসব দেশ হয় সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; নতুবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদারত্ব ছেড়ে সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো দেশের স্বাধীনতা দান হিসাবে অর্জিত হয়েছে। এ তিন পথের বাইরে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র, যা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের সমন্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশের অনন্যতা।
পাকিস্তানের যাত্রালগ্নে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বিকাশ, মর্যাদা ও অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত পাকিস্তানে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে এককেন্দ্রিক শাসনসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে তা পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও পশ্চিমাঞ্চলের পাখতুন, বালুচ, সিন্ধি ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাতে মানুষের স্বাধীন বিকাশের পথ একবারেই রুদ্ধ হয়। একইসঙ্গে কথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তৃণমূল পর্যন্ত একটি সমর্থক-বলয় গড়ে তোলে। ফলে পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম দুষ্কর হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রত্যাশিতভাবেই সামরিক শাসক আইয়ুবের পক্ষে গেলে গণতান্ত্রিক শিবিরে আবারও হতাশা নেমে আসে। এ সময়ে পাক-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যুদ্ধে পরাজয়ের মুখে রাশিয়ার তাসখন্দে পাক-ভারত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সব মহল এ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করলেও বাঙালি স্বার্থের প্রতিভূ শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ চুক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। মুজিব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। স্রেফ ভারতের শুভেচ্ছার ওপর এ অঞ্চল যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
১৯৬৫-এর অসম পাক-ভারত যুদ্ধকে বাঙালি স্বার্থের পক্ষে আপসহীন লড়িয়ে শেখ মুজিব কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত সামান্য গণতান্ত্রিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তীকালে তাসখন্দ চুক্তির পটভূমিতে লাহোরে এক কনভেনশনে মিলিত হয়। উদ্দেশ্য-আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পন্থা কী হবে তা নির্ধারণ। ১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারির এ কনভেনশন যুদ্ধবাস্তবতার আলোকে এবং বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমন্বিত করে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কর্মসূচি তুলে ধরার সুযোগ এনে দেয় শেখ মুজিবকে। তিনি এ কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা হিসাবে ৬টি দাবি উত্থাপন করেন, যা ঢাকায় এসে ৬ দফা কর্মসূচি হিসাবে আখ্যায়িত হয়।
৬ দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তা পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থরক্ষার ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের শক্তির কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। আইয়ুব থেকে শুরু করে তার বশংবদ ফকা চৌধুরী, মোনেম খাঁ, সবুর খাঁ, কাজী মাহাবুদ্দিন প্রমুখ নেতা এবং নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মমতাজ দৌলতানা, মাহমুদ আলী কাসুরী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, মওদুদী ও তার তস্য পদসেবী গো. আযমসহ বিরোধী বাঙালি-অবাঙালি নেতারা ৬ দফার বিরোধিতায় মাঠ সরগরম করে তোলে। আইয়ুব বললেন, অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার মোকাবিলা করা হবে। বিরোধীরা বললেন, এটি বিচ্ছিন্নতার নগ্ন দলিল। এমনকি বামনেতা মওলানা ভাসানীও ৬ দফাকে সিআইএ’র দক্ষিণ এশীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে দেখলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, শেখ মুজিব হচ্ছেন মার্কিন দালাল। সরকারি ও অন্যান্য বিরোধী নেতা তাকে ভারতীয় দালাল আখ্যা দিলেন। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফরমে থাকলেও ৬ দফার বিরোধিতায় একসুরে কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু কেন এমনটা হলো? একমাত্র মস্কোপন্থি ওয়ালি ন্যাপ (পূর্বাঞ্চলে মোজাফ্ফর ন্যাপ) ছাড়া সবাই ৬ দফা আতঙ্কে ভুগতে লাগলেন। যেন ৬ দফার ভূত তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের একাংশ ৬ দফা প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করলেও একই বছরের ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রস্তাবগুলো একটি সুসংঘবদ্ধ কর্মসূচি হিসাবে কাউন্সিলে অনুমোদনসাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা কর্মসূচি অনুমোদন লাভ করে। শেখ মুজিব সারা দেশে ৬ দফাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার তরুণ ও তেজস্বী সহকর্মীদের নিয়ে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এভাবে ৬ দফাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক স্বতন্ত্র স্বাধীন বাঙালির আবাসভূমির আকাঙ্ক্ষার রূপ নিতে থাকে।