জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির নেতৃত্বে ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ প্রতিরোধ ও খরা সহনশীলতা’।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিকমতো বজায় রেখে মানুষ যাতে এই পৃথিবীর বুকে অন্য সব জীবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এক সুন্দর পরিবেশে বেঁচে থাকে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের উদ্দেশ্য। সেখানে ২০২৪-এর এপ্রিলকে মানুষের ইতিহাসের ‘উষ্ণতম এপ্রিল’ বলে তকমা দিয়েছে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস।
শুধু এপ্রিলই নয়, এ বছরের প্রথম তিন মাসে বিগত বছরের একই মাসগুলোর তুলনায় বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু পরিবর্তন মনিটরিং সার্ভিসের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
নিজেদের মাসিক বুলেটিনে কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুনের পর থেকে প্রতিটি মাস আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গ্রহের উষ্ণতম মাস ছিল। ১৯৪০ সালের ডেটার সঙ্গে ক্রস চেক করে বিজ্ঞানীরা গত মাসটিকে প্রাক্–শিল্প সময়ের পর উষ্ণতম এপ্রিল বলে ঘোষণা করেছেন। বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসকে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এল নিনোর প্রভাবেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে, যার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের পানিও অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও খরা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলকে উষ্ণ ও খরাপ্রবণ মনে করা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি উষ্ণতা দেশের সব অঞ্চলে বিপদ ডেকে এনেছে। বড় শহরগুলোতে উষ্ণতাপীয় দ্বীপ (আরবান হিট আইল্যান্ড) সমস্যা নাগরিক জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। ফলে যে খরার সমস্যাকে একসময় আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের জন্য প্রবল বিপদ হিসেবে দেখা হতো, তা এখন যে বাংলাদেশের জন্যও আগামী দিনগুলোতে বড় বিপদ হিসেবে সামনে আসছে, তা নিয়ে আর সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে খরা হবে নতুন বিপদ। মরুকরণ ও খরা বর্তমানে সারা পৃথিবীর পরিবেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম। বিশ্বের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ এরই মধ্যে কমবেশি মরুকবলিত হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে গড়ে প্রতিবছর বিশ্বের কোনো না কোনো অঞ্চলের প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা নতুন করে মরুকরণ হচ্ছে। এটি গোটা মানবগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগজনক। পাশাপাশি আবাদি জমির বিশাল অংশ জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার ফলে অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতরাং বিভিন্ন ধরনের ভূমির অবক্ষয় ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এ জন্য ভূমির অবক্ষয় তথা মরুকরণের বিস্তার রোধ জরুরি হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে, মরুকরণ হচ্ছে শুষ্ক, প্রায় শুষ্ক কিংবা নিম্ন আর্দ্রতাযুক্ত অঞ্চলে ভূমির ক্রমাগত অবনয়ন, যা প্রাকৃতিক বা মানুষের কর্মকাণ্ডজনিত কারণে ঘটে থাকে। খরা হচ্ছে কোনো অঞ্চলে বহু বছরের গড় বৃষ্টির তুলনায় কম বৃষ্টি হওয়া। বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের ওপর মরুকরণ ও খরার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। মরুকরণ ও খরার কারণে আগামী দশকে প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে বলে জাতিসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। মরুকরণ ও খরা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি মানুষের জীবনযাত্রা, জীবিকা, খাদ্য উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।