একটি নাটক দিয়েই লেখা শুরু করি। জাপানি নাটক। নাটকের নাম ‘এক শ বস্তা চাল’। এত সাধারণ নাম যে নাটকটি দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু নাটকের পরিচালক-অভিনেতাদের নাম দেখে একটু দেখতে ইচ্ছা হলো। নাটক দেখে রীতিমতো বোকা বনে গেলাম। এত চমৎকার কাহিনিবিন্যাস, অভিনয়, আঙ্গিক—সবটা মিলিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।
ঘটনাটি ঊনবিংশ শতাব্দীর। তখনো শোগানদের দাপট জাপানে। শোগানরা বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে পেশিশক্তিকে বেশি বিশ্বাস করত। সবকিছুর সমাধান হবে তলোয়ারের মাধ্যমে। অর্থাৎ, গায়ের জোরই সব। ওই সময় জাপানের গ্রামাঞ্চলে একটি দুর্ভিক্ষ হয়। এই এলাকায় ত্রাণকার্যের জন্য এক শ বস্তা চাল আসে। ক্ষুধার্ত মানুষেরা এলাকার বৃদ্ধ প্রশাসকের কাছে চালের জন্য ধরনা দেয়। কিন্তু ওই বৃদ্ধ কর্তা নির্বিকার। তিনি বলেন, এক কণা চালও তিনি দেবেন না। শোগানদের কাছে খবর যায়। ওই বৃদ্ধ কর্তাকে হত্যা করার জন্য লোক আসে। বৃদ্ধ এবারও নির্বিকার। কিন্তু শোগানরা বৃদ্ধ বা রোগগ্রস্ত কোনো মানুষকে হত্যা করে না বলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি আসল কারণটি ব্যাখ্যা করেন। বিষয়টি হচ্ছে, এক শ বস্তা চাল এসেছে, তা যদি বণ্টন করা হয়, তাহলে প্রতিটি পরিবারের ভাগে পড়বে ছয় ছটাক করে চাল। এই চাল দিয়ে পরিবারগুলোর একবারের খাবারও হবে না। তাই তিনি ভেবেছেন, এই চাল বিক্রি করে তিনি বাঁশ কিনবেন।
সেই বাঁশ দিয়ে একটি স্কুল নির্মাণ করবেন। ওই অঞ্চলে তখন কোনো স্কুল ছিল না। স্কুলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে দুর্ভিক্ষের কারণ এবং সমাধান জানতে পারবে। আপাতত মানুষ যেভাবে বেঁচে আছে, সেভাবেই তারা দুর্ভিক্ষের সময় পার করে দিতে পারবে। এরপর দেখা গেল, দুর্ভিক্ষের সময় শেষ হলো। স্কুলটি থেকে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে বেরিয়ে জাপানের মেইজি সংস্কারে অংশ নিল এবং পেশিশক্তির বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিক একটি সমাজের দিকে এগিয়ে এল।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এ নাটকটির উদাহরণ কেন টেনে আনলাম? বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের কথা চিন্তা করলেই আমরা প্রথমত, সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারতাম। যে সংস্কৃতি বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। আবার স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও এই বুদ্ধিবৃত্তিক নাগরিকেরাই অংশ নিয়েছিল। বর্তমানে দুটি বিষয় সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটি ধর্ম, অন্যটি পেশিশক্তি, যার পেছনে আছে টাকা। ধর্ম, পেশিশক্তি এবং অর্থের উত্থানের কারণ একটি সুশিক্ষা ও সংস্কৃতির ভয়াবহ অনুপস্থিতি। দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলার কারণে সমাজের মূল্যবোধে বড় আকারের একটা ফাটল ধরেছে। এই ফাটলে ঢুকে পড়েছে ধর্মব্যবসায়ী এবং অসৎভাবে উপার্জিত অর্থ। সেই অর্থবান লোকেরা দেশের আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রশাসনে ঢুকে পড়েছে। আর তাদের ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অর্থ।
যেসব স্থানে ক্ষমতা আছে, সেই সব জায়গা অসৎ উপার্জনের একটা ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই দুর্নীতি মানে এখন ‘হাজার লাখের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ‘হাজার কোটি’ ছাড়া দুর্নীতির কোনো কথাই বলা যায় না। কোনো কোনো সরকারি অফিসের পিয়ন-ড্রাইভাররাও হাজার কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতি করতে বাধা কোথায়! বাধা একটাই—মূল্যবোধ এবং বিবেক। এই মূল্যবোধ এবং বিবেকের জন্ম হয় ব্যক্তির সংস্কৃতি চিন্তা থেকে। শিক্ষা সেখানে একটা বড় উপাদান। কিন্তু শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করে সংস্কৃতি। একটি সংস্কৃতি ছড়িয়ে থাকে পরিবারে, বিদ্যালয়ে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন মানুষের মধ্যে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখনকার নেতারা একটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গড়ার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। কিন্তু সব সময়ই এই মন্ত্রণালয়কে অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। বিদেশিদের ভাষায় ‘ফুড ফর ওয়ার্কস’ এবং বাংলায় ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রকল্পের সংক্ষেপিত শব্দ ‘কাবিখা’ করে মানুষকে প্রাণী হিসেবেই দেখা হয়েছে। মানুষ কি শুধু খাদ্যের জন্যই কাজ করে? আর কিছু তার প্রয়োজন হয় না? বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন কিছুই লাগে না? সারা দিন কাজের পর কিছু গম দিয়ে তাকে বিদায় করা হলো। তার কি আলো জ্বালানোর জন্য একটা হারিকেন লাগে না? রান্না করার উপকরণ লাগে না? সন্তানের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন হয় না?
কোনো সংস্কৃতিমান মানুষ এ ধরনের প্রকল্প করতে পারত না। প্রকল্পের প্রশাসকদের দেখে সেই পুরোনো প্রবাদই মনে হলো—সব সভ্য মানুষই সংস্কৃতিমান নয়। এখানে সভ্য বলতে অবশ্য জামা-জুতা পরা মানুষকেই বোঝানো হয়েছে। আজ আমাদের জীবনে যে বিশৃঙ্খলা, যে দুর্নীতি, এর কারণও কিন্তু ওই সংস্কৃতিহীনতা, মানে আরও সহজ ভাষায় ‘অপসংস্কৃতি’। একটির বিপরীতে আরেকটি সব সময়ই দাঁড়িয়ে থাকে। সংস্কৃতির অভাব সমাজের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসটি নিয়ে আসে তা হলো, নিরাপত্তাহীনতা। নিরাপত্তাহীনতাই তো দুর্নীতির প্রধান অস্ত্র। আমার অধিকার ভোগ করতে না দেওয়াই তো প্রধান কৌশল। যা-ই হোক, সুদীর্ঘ দিনের বাজেট পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে অবহেলাটা কত বড়। এর মধ্য দিয়েই শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব সহজেই বোঝা যায়। বাজেট বাড়ালেই কি সাংস্কৃতিক উন্নয়ন হয়ে যাবে? যে বাজেট দেওয়া হয় তা-ই তো অনেক সময় খরচ করতে পারে না। টাকা ফেরত যায়। কেন ফেরত যায়—কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, ব্যয়ের সঠিক জায়গা খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।