ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনেক চমক উপহার দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদিই হয়তো তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি-ম্যাজিক বলে যে কথাটি চালু হয়েছিল, সেটা এবার কাজ করেনি। মোদি নিজে জিতেছেন, জিতেছেন তাঁর সব কাজের দোসর হিসেবে পরিচিত অমিত শাহও। কিন্তু চার শ পার বলে যে গালভরা বুলি কপচানো হয়েছিল, তা হয়নি। মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে বুথফেরত জরিপের পূর্বাভাস।
বিজেপি একক দল হিসেবে বেশি আসনে জয় পেলেও সরকার গঠনের জন্য যে ম্যাজিক ফিগার—২৭২ আসন, সেটা পায়নি। মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য এবার অন্যের দুয়ারে ধরনা দিতে হবে। বলা হচ্ছে, এবার মোদি হবেন ‘পরনির্ভর’ প্রধানমন্ত্রী। এবারের নির্বাচন মোদির ভাবমূর্তি ম্লান করেছে, আর উজ্জ্বল তারকা হিসেবে সামনে এসেছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী। এত দিন মোদি নিজে এবং তাঁর সঙ্গীসাথিরা রাহুলকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেন, এবার রাহুলের সামনে বদলা নেওয়ার সুযোগ এসেছে।
ভারতের লোকসভার আসনসংখ্যা ৫৪৩। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ২৭২ আসন। যেহেতু বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ২৯৩ আসনে জয় পেয়েছে, সেহেতু এই জোটেরই সরকার গঠনের কথা। কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে ২৩৩ আসন। এ ছাড়া অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে পেয়েছেন ১৭টি আসন। তবে দল হিসেবে এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে বিজেপি। দলটির দখলে গেছে ২৪২ আসন। এরপর জোটসঙ্গী দলগুলোর মধ্যে তেলুগু দেশম পার্টি পেয়েছে ১৬ এবং বিহারের নীতীশ কুমারের দল জনতা দল (ইউনাইটেড) পেয়েছে ১২টি আসন।
কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া পেয়েছে ২৩৩ আসন। এই ২৩৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯টি আসন। জোট শরিক উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে ৩৬, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২৯, দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাগাম পেয়েছে ২২টি আসন। এর বাইরে শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে) পেয়েছে ৯টি আসন। শারদ পাওয়ারের ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি পেয়েছে ৮টি আসন।
বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক দল আবারও ভারত শাসনের ভার পাক, সেটা ভারতবর্ষের অনেকেই চাননি। এই ‘অনেক’ মানে লাখ, নাকি কোটির ঘরে, তা হিসাব করে কেউ দেখেননি। আবার ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপিই ক্ষমতায় ফিরে আসুক, এটাও অনেকেই চেয়েছেন। এই ‘অনেক’ সংখ্যাটাই যে বেশি, সেটা ভোটের ফলাফল থেকে বোঝা যাচ্ছে। মোদির জনপ্রিয়তা কমেছে, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, মিত্রদের সাহায্য ছাড়া গতি নেই—এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে রাজনৈতিক জ্যোতিষীদের সব গণনা সব সময় নির্ভুল হয় না। মোদির বিজয়রথ থামানোর ক্ষমতা বা তাঁর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা কারও হয়নি বলে যে প্রচারণা এক দশক ধরে চালানো হয়েছে, তা চ্যালেঞ্জ করে দাঁড়িয়ে গেছেন রাহুল গান্ধী। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনাই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদের কথা বলে ভারতের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটানোর পথে হেঁটে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি করেছেন। ধারণা করা হচ্ছিল, ধর্মই বুঝি রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ আসনে বিজেপির প্রার্থী লাল্লু সিং হেরে যাওয়ায় কী মনে হচ্ছে? ওই আসনটিতে জিতেছেন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী অবধেশ প্রসাদ। উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ কেন্দ্রের মধ্যেই রামমন্দির অবস্থিত। ২০১৮ সালে ফৈজাবাদ জেলার নতুন নামকরণ করা হয় অযোধ্যা। তবে লোকসভার এই আসনটিকে এখনো ফৈজাবাদ বলা হয়।