বাংলাভাষায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। র্যাব ও পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ছিলেন তেমন দর্শনধারী একজন ব্যক্তি। স্মার্ট, সুদর্শন। কথাও বলেন সুন্দর করে গুছিয়ে। যতদিন পদে ছিলেন, ততদিন তার ‘গুণ’ নিয়েও কোনো গুঞ্জন বা প্রশ্ন ওঠেনি। এই নম্র-ভদ্র স্বভাবের ব্যক্তিটি পুলিশ প্রধান হিসেবে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গেই তার দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর গ্রহণের দুই বছরের মাথায় সেই লাজুক-রাঙা সুন্দর চেহারার ‘হিরো’ মানুষটি আকস্মিকই ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অবিশ্বাস্য সব কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার পর আদালত তার সব ব্যাংক একাউন্ট ‘ফ্রিজ’ ও সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ জারি করেছে। আদালতের এই তোলপাড় করা নির্দেশের পর বেনজীরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হ্যাঁ, শত শত কোটি টাকার সম্পদ বানানোর চমকের পর তিনি আবারও চমক দেখিয়েছেন। একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, সম্পত্তি জব্দের নির্দেশের আগেই সব বেচে দিয়ে গত ৪ মে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি। যাওয়ার আগেই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক আকাউন্ট থেকে তুলে নিয়েছেন টাকা!
বেনজীরের সম্পত্তি বানানো এবং সকল ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাটি বর্তমানে টক অফ দ্য কান্ট্রি। সকলের বিস্ময়: তিনি এত সম্পত্তি বানালেন কীভাবে? আপিল বিভাগের সদ্য বিদায়ী বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবসে বিদায়ী সংবর্ধনা-সভায় বেনজীরের সম্পত্তি বানানোর দিক ইঙ্গিত করে বলেন: ‘একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি এমনকি শত কোটি টাকার মালিক হন তা দেশবাসীকে হতবাক করে। তাই এগুলোকে রোধ করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
মহামান্য বিচারপতি যা বলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে যা হওয়ার কথা, যার যা করার কথা তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। এই যেমন বেনজীর আহমেদ যখন আইজিপি হিসেবে একজন ‘সেরা করদাতা’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তখন সবাই বাহবা দিয়েছিলেন। ২০২১ সালে তাকে সেরা করদাতা নির্বাচিত হওয়ার সময়েই তিনি ও তার পরিবার ১৩৮ একরেরও বেশি জমির মালিক ছিলেন। অথচ তার সম্পদ ও আয় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রশ্ন তোলেনি। কেউ কোনো অনুসন্ধানও করেনি।
তিনি ১১২ একর জমি কিনেছেন পুলিশ ও র্যাব প্রধান থাকাকালে। অথচ কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি জমি কেনে, তাহলে তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার নিয়ম আছে। বেনজীর সাহেব সেই নিয়ম মানেননি। সংবাদপত্রে খবর বেরুচ্ছে যে, তিনি সেই সময়, পুলিশ প্রধানের পদকে ব্যবহার করে অধস্তনদের দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি জোর করে লিখে নিয়েছেন। সেই সময় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী বেনজীরের ভয়ে সবাই চুপ থেকেছেন অথবা সব কিছু চেপে গেছেন।
চাকরিতে থাকাকালে তিনি নীতি-নৈতিকতা-বিষয়ক পুরস্কারও জিতেছেন। বেনজীর যখন পুলিশ প্রধান ছিলেন, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ তাকে ২০২০-২১ সালে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দেয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ও তার পরিবার সেই সময় অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন।