দেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা দিনের পর দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একশ্রেণির ধান্দাবাজ ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজার থেকে ফায়দা লুটে বাজারটিকে ফোকলা করে ফেলেছেন। এসব ব্যক্তি নিজেদের কোম্পানির হাজার হাজার কোটি টাকা এখান থেকে হাতিয়ে নিয়ে তাদের কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সেসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। আবার দেশে বসেও কেউ কেউ কলকাঠি নাড়ছেন। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচ্চপদে পোস্টিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসব ধান্দাবাজের গুরু বলে খ্যাত এক ব্যক্তির ইশারা-ইঙ্গিতেই চলে বলে শোনা যায়! অন্যথায় শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইতঃপূর্বে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানকে তিন দফায় একনাগাড়ে তিন মেয়াদে চেয়ারটিতে বসিয়ে রাখা হতো না, আবার বর্তমান চেয়ারম্যানের এক মেয়াদ ব্যর্থতায় কাটানোর পরও এবং তার ব্যর্থতার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে আবারও এক মেয়াদের জন্য এক্সটেনশন দেওয়া হতো না।
এ অবস্থায় একই সরকারের আমলে বারবার পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া দেশের সিকিউরিটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অনায়াসেই যে প্রশ্নটি তুলতে পারেন তা হলো, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় বড় চেয়ারে বসা কর্তাব্যক্তিরা বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে চেয়ারে বসে থাকেন, নাকি ধান্দাবাজদের লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তাদের সেখানে বসানো হয়? অন্যথায় যে কোম্পানিটির একদিনে তিনশ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হতো, অল্পদিনের ব্যবধানে সেই একই কোম্পানির শেয়ার একদিনের লেনদেনে তিন হাজার টাকার ঘরও স্পর্শ করে না কেন? এক্ষেত্রে তো বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, যখন প্রায় প্রতিদিনই সেই কোম্পানির শেয়ার দুইশ-তিনশ কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হতো, সেখানে তখন ভীষণ অনিয়ম ঘটত, কারসাজির মাধ্যমে একদিনে এত বেশি অঙ্কের বা মূল্যের শেয়ার লেনদেন করা হতো, সে সময়ে দিনের পর দিন একটি একক কোম্পানির শেয়ার একদিনের লেনদেনে দুইশ কোটি টাকার অঙ্ক ছাড়িয়ে যাচ্ছে; অথচ বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন নামধারী প্রতিষ্ঠানটি তা চেয়ে চেয়ে দেখছে, তাদের মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে না, এটা কি স্বাভাবিক? নাকি তাদের ধারণা বা তারা জানে, কোম্পানিটি অত্যন্ত মূল্যবান, বিখ্যাত বা লিস্টেড কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৌলভিত্তিসম্পন্ন, প্রতিবছর পর্যাপ্ত ডিভিডেন্ড প্রদান করে থাকে বিধায় প্রতিদিন এত বেশি অঙ্কের লেনদেন হচ্ছে! কিন্তু এসবের কোনোটিই না হওয়া সত্ত্বেও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে প্রতিদিন সেই কোম্পানির শত কোটি থেকে তিনশ কোটি টাকার শেয়ার হাত বদল হতো; এখন যা দৈনিক তিনশ থেকে তিন হাজার টাকার বেশি হয় না, আবার কোনো কোনো দিন একটি শেয়ারও লেনদেন হয় না। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তখনো চুপ করেছিল, এখনো চুপ করে আছে! সে সময়ে যদি বিষয়টির গভীরে গিয়ে দৈনিক অস্বাভাবিক লেনদেনসহ কোম্পানির অন্যান্য ভালো-মন্দ দিক উন্মোচন করে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করা হতো, তাহলে সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে আজ পথে বসতে হতো না। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে যে এক ধরনের লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ, কোম্পানির মালিক অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তারা নিজেদের ব্রোকার হাউজের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন। কেউ যদি জানতে বা বুঝতে চান, তাহলে তথ্য-প্রমাণসহ কোম্পানির উপরোক্ত কারসাজি প্রমাণ করা যাবে।
আমাদের পুঁজিবাজারে কারসাজির মাধ্যমে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের যে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে, সে কথাটি এখন সর্বজনবিদিত। এ অবস্থায় আমরা সবাই এসব অন্যায়-অনাচার চেয়ে চেয়ে দেখব, যুগ যুগ ধরে সে অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। আমাদের কাউকে না কাউকে এসব ঘটনা তুলে ধরতে হবে, অন্যথায় সেয়ানা ঘুঘুদের ধান খেয়ে যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। পুঁজিবাজারের ঘুঘুদের ধরতে হলে যার যার অবস্থান থেকে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। একইসঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাথায় বসে যারা ঘি-মাখন খাচ্ছেন, বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ-সুবিধা এবং ফায়দা লোটার জন্য একই পদে বারবার যারা এক্সটেনশন নিচ্ছেন, তারাও যে পুঁজিবাজার লুটপাটের অংশীদার, সে বিষয়টিও জনসমক্ষে আনা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যথায় আরও কিছু সময় অপচয় করলে হয়তো দেখা যাবে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিদেরও কেউ কেউ বিরাট বিরাট অন্যায়-অনিয়মের মাধ্যমে ফায়দা লুটে রাঘববোয়াল বনে গেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদটি একজন সিনিয়র সচিব মর্যাদার। সে ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা ছাড়াও তিনি বাবুর্চি, বডিগার্ড, বাড়ির দারোয়ানসহ আনুষঙ্গিক আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে এক মেয়াদের জন্য কেউ চেয়ারটি পেলে শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও পরে সহজে তা ছাড়তে চান না, চেষ্টা-তদবির করে দ্বিতীয়, তৃতীয় মেয়াদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান। আর এসব কারণে তারা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিরাগভাজনও হতে চান না। ফলস্বরূপ যারা এক্সটেনশন দেন বা করিয়ে দেন, তারাও এসব ব্যক্তির মাধ্যমে ফায়দা লুটে নেন। আর এভাবেই পারস্পরিক যোগসাজশে দেশের পুঁজিবাজার একটি অবাধ লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।