ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পর দেশজুড়ে ১৬ জনের প্রাণহানি, দুই লাখ ঘর বিধ্বস্ত, বন বিভাগের ৭ কোটি টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতিসহ এবারই প্রথম গণমাধ্যমজুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে সুন্দরবনের নিদারুণ ক্ষত। ৯৬টি হরিণ ও ৫টি বুনো শূকরের লাশ পাওয়া গেছে। কটকা অভয়ারণ্যের জামতলায় ৩৮টি হরিণের লাশ পাওয়া গেছে। কচিখালীর সুপতি খাল থেকে উদ্ধার হয়েছে ১০টি হরিণের লাশ।
২০০৭ সালে সিডরের পর দুর্যোগ মোকাবিলায় সুন্দরবনের ভূমিকা ও অবদানকে আমরা কিছুটা আলোচনায় আনতে পেরেছি। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা বা নথি-দলিলের মাধ্যমে সুন্দরবনের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চলতি লেখাটি ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সংঘটিত সুন্দরবনের সামগ্রিক ইকোনমিক ও নন-ইকোনমিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের দাবি করছে। পাশাপাশি এই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে প্রকৃতি ও সংস্কৃতি-সংবেদনশীল তৎপরতা, বাজেট বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছে; ঘূর্ণিঝড়সহ সব আপদ-বিপদে সুন্দরবনের জানমালের সুরক্ষাকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় যুক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরছে।
২০০৯ সালে আইলার সময় জোয়ারের পানি বাঁধ ভেঙে গ্রামে ঢুকলে তলিয়ে যায় জীবন ও বসতি। এবার রিমালে একই রকম ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর জীবনে। প্রায় দুই দিন নোনাপানিতে তলিয়ে ছিল বন। এবার জোয়ারের উচ্চতা ছিল বেশি। বন বিভাগও গণমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে, দীর্ঘ সময় জলোচ্ছ্বাস থাকায় ১০ ফুট পানির নিচে সুন্দরবন ডুবে থাকায় বন্যপ্রাণীর এত ক্ষতি আগে সুন্দরবনে হয়নি, যা ঘটেছে রিমালের আঘাতে। এমন জলোচ্ছ্বাস ও নোনাপানিতে হরিণের মতো অতি নাজুক প্রাণী দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারেনি। একই ঘটনা বুনো শূকরের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এ ছাড়া উদ, বেজি, ব্যাঙ, গুইসাপ ও অন্যান্য সরীসৃপ বিপদে আছে। বনতল ও বনের মাঝারি স্তরের পাখিরা খুবই বিপন্ন। কারণ জোয়ারের পানিতে বহু পাখির বাসা ভেসে যাওয়ার কথা।
এই সময়টা সুন্দরবনের মধু মৌসুম। বহু মৌমাছির চাক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। খলিশা, গোল, গরান, হেন্তালের ঝোপে যেসব চাক আছে বা বনের মাঝারি উচ্চতার গাছের ডাল ও খোঁড়লে যেসব চাক আছে, সেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রচুর রানী মৌমাছি মারা যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সব মৌমাছির চাক ত্যাগ করা হয়তো সম্ভব হয়নি। তুলনামূলক বানর ও বাঘ হয়তো নিজেদের জীবন বাঁচাতে বেশি তৎপর থাকতে পেরেছে। রিমালের কারণে সুন্দরবনের ভেতরে থাকা মিঠাপানির পুকুরগুলো নোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। মৌমাছি থেকে শুরু করে হরিণ, বাঘসহ সব বন্যপ্রাণীর খাবার পানির তীব্র সংকট তৈরি হবে। একই সঙ্গে সব বন্যপ্রাণীর বিচরণ অঞ্চল এবং খাদ্য উৎসেও সংকট তৈরি হবে।
সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ
সুন্দরবনের মতো এক জটিল বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ দুঃসাধ্য। কাজটি করার জন্য আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সব স্তর থেকে সহযোগিতা দরকার। রাষ্ট্রীয় ও পাবলিক প্রতিষ্ঠান বিষয়টি সমন্বয় করতে পারে। স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, নাগরিক সংগঠনগুলো যুক্ত করা জরুরি। বনের সর্বস্তরের উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীব কেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তা সামগ্রিকভাবে জানা-বোঝা জরুরি।
সুন্দরবন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আমরা বন্ধ করতে পারব না। আগেভাগেই জোরালো ব্যবস্থাপনাগত প্রস্তুতি না থাকলে কোনোভাবেই এই প্রাকৃতিক ঢালকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। সেই চাপ সামাল দেওয়ার মতো অর্থনীতি, উৎপাদন, রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক সংস্কৃতি– কিছুই দুনিয়ার কোথাও এখনও গড়ে ওঠেনি।