ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে এবার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষত উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের ১৯ জেলায় মাছ ও চিংড়িঘেরের ওপর ভয়ংকর তাণ্ডব আঘাত হেনেছে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, খুলনার পাইগাছা ও কয়রায় ৫ হাজার ৫৭৫টি মাছের ঘের, ৩৫ হাজার চিংড়িঘের নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
উপকূলীয় জেলাগুলোতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বেকার যুবকরা মাছ চাষের ওপর নির্ভর করে এলাকার অর্থনীতিকে সচল রাখে। তাদের ঘেরে কাজ করে হাজারো শ্রমিক। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে শুধুই কান্না এখন তাদের সবার চোখে। আশ্রয় শিবির থেকে তারা প্রাণে বাঁচলেও বাড়িতে ফিরে দিশেহারা। কাদা-বালুর বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন মালিকানার ঘেরের সীমানা একাকার হয়ে যাওয়া জলরাশির দিকে তাকিয়ে নিজেদের চিংড়িঘেরের নিশানা খুঁজে পাচ্ছেন না।
মাছ বিক্রির অর্থ যাদের জীবিকার প্রধান উপায়, একের পর এক দুর্যোগে তাদের অনেকেই নিঃস্ব হওয়ার উপক্রম। তারা এ বছর ঘেরে পোনা ছেড়েছিলেন। মোরেলগঞ্জের চিংড়িচাষিদের অভয় দেওয়া হয়েছিল, এখানকার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ১৪ ফুট। এত উঁচুতে পানি উঠবে না। কিন্তু ঝড়ের সময় পানির উচ্চতা ১৬ ফুট পেরিয়ে বাঁধ ভেঙে গেছে। সব মাছ চলে গেছে। এক হিসাব বলছে, রিমালে ৬৯৭ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া ৫৪১টি নৌযান, ৬৩৫টি স্লুইসগেট ক্ষতিগ্রস্ত।
পূর্বেকার ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডরের চেয়ে এবারের রিমাল ছিল মাঝারি ও মৃদু ধরনের। দিনের বেলায় আঘাত হেনেছে বেশি। তবু ১৯ জনের মৃত্যুসহ কেন এত ক্ষয়ক্ষতি? এবার মৎস্য, চিংড়িঘেরের ওপর নির্ভরশীল মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেন কীভাবে– সেই দুশ্চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছেন।
এতদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও রিমালের তাণ্ডবে নিঃস্ব হয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাতাদের দোষারোপ করছেন। তারা অভিযোগ করছেন, রিমাল আসার আগেই জোয়ারের চাপে অনেক স্থানে বাঁধ ভাঙা ছিল। সেগুলো মেরামত করা হয়নি। রিমালের প্রভাবে ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে মৎস্য, চিংড়িঘের বিলীন হয়ে সবকিছু একাকার হয়ে গেছে।
প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ আসে বিপুল পরিমাণে কিন্তু বেড়িবাঁধ সেই অনুযায়ী মজবুত করে মেরামত করা হয় না। কাদা-বালুর বাঁধ প্রতিবছর জোয়ারের পানির ধাক্কায় ভেঙে যায়। অনেকেই জানাচ্ছেন, তারা কোনো ত্রাণ চান না। কংক্রিট দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি করেন। এর প্রতিফলন দেখা গেছে– একজন যুবক খোলা শরীরে বুকের মধ্যে ‘ত্রাণ চাই না, শক্ত বাঁধ চাই’ লিখে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন। এ বছর রিমালের প্রভাবে মৎস্য, চিংড়িঘেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবে ঠিকাদারদের উদাসীনতা ও অবহেলাকে দায়ী করা হচ্ছে প্রায় সব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের পক্ষ থেকে।
উপকূলীয় এলাকায় যত বড় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হোক না কেন, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা মানুষের মধ্যেই নিহিত। এ জন্য আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কী কী করতে হবে তা মানুষের বোধগম্যতার মধ্যেই নিবিষ্ট। কিন্তু প্রতিবছর বরাদ্দের টাকা লুট করে মজবুতভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা না হলে এবং প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালালে এর দায়ভার কে নেবে?