জাতীয়তাবাদ কী ও কেন, সেটা আমরা মোটামুটি জানি। জানি যতটা তার চেয়ে অধিক বুঝি। কেননা জাতীয়তাবাদ আমাদের জন্য অভিজ্ঞতার ব্যাপার, ব্যাপার দুর্ভোগেরও। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আমরা ভুক্তভোগী বটে। হিটলার মুসোলিনীর আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। ইসরায়েলের জাতীয়তাবাদী নিষ্ঠুরতাকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জর্জ বুশ আমেরিকান জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে বিশ্ব জয়ে বের হয়েছিলেন।
এসব নেতির দিক। ইতির দিক অবশ্যই রয়েছে। সেটা হলো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটা নিজস্ব জায়গা। বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিকতাকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয়তাবাদ প্রয়োজন। কেননা বিশ্বায়ন হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদেরই আরেকটি রূপ, যা এক করার নামে বিশ্বকে সত্যিকার অর্থে গ্রাম্য, বৈচিত্র্যহীন ও সংকীর্ণ করে তুলতে চায়। অপর দিকে আন্তর্জাতিকতা সব জাতিসত্তার নিজস্বতাকে মানে ও সম্মান করে, জাতিতে জাতিতে সহযোগিতা সব জাতিসত্তার নিজস্বতাকে মানে ও সম্মান করে, জাতিতে জাতিতে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা তৈরি করতে চায়; সে তাই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের শত্রু নয়, ঘনিষ্ঠ মিত্র বটে। পুঁজির কোনো দেশ নেই; কিন্তু মানুষের তা আছে, সে দেশ যদি কেবল কল্পনারই হয়, তবুও। পুঁজিবাদ যে শ্রমিকশ্রেণিকে গৃহহারা, উৎপাটিত ও বিচ্ছিন্ন করে, তাতে শ্রমিকের জন্য আনন্দ নেই, গভীর মর্মবেদনা রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ এখন আরও নির্লজ্জ হয়ে পড়েছে, কেবল বিশ্বায়নের বাণিজ্য ও পুঁজি লগ্নির ক্ষেত্রে নিজেকে আবদ্ধই রাখছে না, ভূমি দখল করে নিচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দিচ্ছে দেশে দেশে, চালাচ্ছে জবরদখলদারি। চাইছে স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয় মুছে দেবে, বিশেষ করে প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য পাল্টা জাতীয়তাবাদ দরকার, যাকে আমরা গণতান্ত্রিক বলতে পারি, যে জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী নয়, কোনো বিশেষ শ্রেণির নয় এবং যার দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে আন্তর্জাতিকতা। সে যেমন আশ্রয় দেয়, তেমনি হাত বাড়ায় সহযোগিতার, বিশ্বের দিকে।
জাতীয়তাবাদ আসলে একটা অনুভূতি। তাতে দেশপ্রেম থাকে, কিন্তু দেশপ্রেম থেকে আবার তা স্বতন্ত্রও বটে, ব্যাপকও। কেননা প্রথমত, দেশপ্রেমের তুলনায় জাতীয়তাবাদ অনেক বেশি রাজনৈতিক। দ্বিতীয়ত, একটি জাতি কেবল একটি দেশ নয়, বিভিন্ন দেশে বসবাস করতে পারে, করেও। বাঙালিরা আজ যেমন করছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ ভিন্ন অর্থে দেশের কথা ভাবেও, না-ভেবে পারে না। সেই দেশ যতটা না দৃশ্যমান, তার চেয়ে বেশি কল্পনার, তাতে স্মৃতি থাকে অতীতের, স্বপ্ন থেকে ভবিষ্যতের, স্বপ্ন ও স্মৃতি মিশে একাকার হয়ে যায়। এই স্বপ্নটা খুবই জরুরি। কেননা সমষ্টিগত স্বপ্ন ছাড়া কোনো জাতি বাঁচতে পারে না। এমনকি টিকে থাকাও কঠিন।
সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের কোনো বিরোধ নেই, মৈত্রী রয়েছে। সমাজতন্ত্র দেশে এবং সারা পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, পুঁজির আন্তর্জাতিকতা করে ঠিক এর উল্টো কাজ, সে সৃষ্টি করে বৈষম্য। সমাজতান্ত্রিক সাম্যের অর্থ স্থানীয় ও ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ নয়, বরং ওই স্বাতন্ত্র্যের জন্য বিপদমুক্তি। এ সাম্য বাগানের, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফোটে, কিন্তু একটি অপরটির ওপর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে চায় না।
লেনিন, মাও সে তুং, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন—তাঁরা সবাই সমাজতন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু সেই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী যে ছিলেন না, তা-ও নয়।
নিজ নিজ দেশে তাঁরা জাতীয় মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত হোক, এটাও চেয়েছেন। এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সারা বিশ্বের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোনো বিরোধ নেই, ঐক্য রয়েছে। লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিভিন্ন জাতীয় সত্তার নিজস্বতার স্বীকৃতি ছিল, তাদের দেওয়া হয়েছিল বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারও। সেই ব্যবস্থার পতনের পর যে জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় ঘটেছে, তারা কেবল উগ্রই নয়, আদিপত্যবাদীও, যে জন্য রাষ্ট্রের ভেতরে যেমন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দিয়েছে, তেমনি বাইরেও এককালের মিত্র জাতিসত্তাগুলো পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনকে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান মনে করার কোনো কারণ নেই, সেটি পুঁজিবাদী অভ্যুত্থান বটে। স্মরণীয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে মুসোলিনী নিজেকে একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবেই জাহির করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক দলের সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক ছিলেন এবং দলকে সংগঠিত করে তোলার ব্যাপারেও অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। কিন্তু পরে তিনি আর সমাজতন্ত্রী থাকেননি, নিজেকে এবং সেই সঙ্গে শ্রেণির স্বার্থকে প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয়েছেন এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। লেনিনের সঙ্গে মুসোলিনীর ব্যবধান ওখানেই; লেনিন সর্বদাই ছিলেন একাধারে জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিকতাবাদী, মুসোলিনী যা ছিলেন না। হিটলারও জার্মানিতে তাঁর নিজস্ব ফ্যাসিবাদী তৎপরতাতেই লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের জাতীয়তাবাদ ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয় না, ব্যক্তিকে রাষ্ট্র ও তথাকথিত জাতির সেবকে পরিণত করে। পুরুষদের বলে একজন স্বামী, পিতা ও সৈনিক হতে; নারীদের নির্দেশ দেয় সৎ গৃহিণী, পরিবারের প্রতি নিবেদিতচিত্ত এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অধিক সন্তানের জননী হওয়ার। ফ্যাসিবাদীরা উগ্র জাতীয়তাবাদী আর সেই কারণেই তারা সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের বিরোধীও বটে। বলা বাহুল্য, প্রকৃত গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। কেননা সেই গণতন্ত্রের একেবারে প্রথম অঙ্গীকার হলো, মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।