প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ ছুঁয়ে গেল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশকে; সোমবার দুপুরের পর এই নিবন্ধ যখন লিখতে বসেছিলাম, তখন সেটার কেন্দ্রবিন্দু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অতিক্রম করছিল। আর লেখা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ৬টার দিকে সেটা পদ্মা ও যমুনার মিলনস্থল রাজবাড়ী, পাবনা, মানিকগঞ্জ এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিল।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে এখন ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ব্যবস্থা অনেক উন্নত। নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া থেকে দিন-তারিখ ধরে এর সম্ভাব্য গতিপথ আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়। যেমন উইন্ডিডটকম নামে আবহাওয়া-বিষয়ক ওয়েবসাইটে গিয়ে নিজের সেলফোন থেকেই রিমালের প্রতি মুহূর্তের গতিপথ দেখতে পাচ্ছিলাম।
কেবল রিমালের গতিপথ দেখতে পাওয়া নয়; ঢাকায় নিজের দপ্তর বা গাড়িতে বসেও টের পাচ্ছিলাম বর্ষণ ও দমকা হাওয়ার বেগ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান বিকেলেই সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক।
বস্তুত ঢাকায় বসে আমরা যেভাবে সংবাদমাধ্যম বা সরকারি তথ্যবিবরণীতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ও তথ্য দেখে থাকি, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর কাছে বিষয়টি তেমন নয়। তাদের কাছে ঘূর্ণিঝড় মানে জীবন ও সম্পদ দিয়ে দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়।
অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের মতো রিমালও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে উপকূলীয় জীবন-জীবিকা। আমরা জানি, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বাতাসের গতিবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়; প্রবল বর্ষণে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস ঘটে। ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর জলাবদ্ধতা ও পানিবাহিত রোগ মোকাবিলা করতে হয় দুর্যোগাক্রান্ত মানুষকে।
স্বীকার করতেই হবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে; বেড়েছে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা। দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে উপকূলীয় মানুষ তাদের লোকায়ত জ্ঞান ব্যবহার করে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে পায়। তবে সামাজিক স্তরবিন্যাসের এই সমাজে যা আবার কঠোর শ্রমবিভাজন দ্বারা বিভক্ত; সেখানে সবার নিজ শক্তি দিয়ে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়কে মোকাবিলার সামর্থ্য সমান নয়। অনেকের মাঝে তেমন প্রস্তুতি নেওয়ার মানসিকতাও নেই।
রিমাল এতটা তীব্র হয়ে উঠবে– সেটি অনেকেই ভাবেনি। তার পেছনে একটি কারণ হিসেবে দেখা যায়, গত বছর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোকার অভিজ্ঞতা। মোকাকে ‘সুপারসাইক্লোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছিল দ্বীপ ও চরাঞ্চলে। উপকূলীয় জেলাগুলোয় দেওয়া হয়েছিল ৮ নম্বর বিপৎসংকেত। যদিও ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আভাস ছিল, বাস্তবে সেটা ৩ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত উঠেছিল। আবার সম্ভাব্য গতিপথ বদলে মোকা বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিল মিয়ানমারের দিকে। হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে উপকূলের অনেকে রিমাল নিয়ে ততটা সতর্ক ছিলেন না।
অবশ্য সরকারের দিক থেকে আগের ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতির ওপর ভরসা করে বসে থাকার অবকাশ থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে সার্বক্ষণিক যে কোনো দুর্যোগের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন ও নির্দেশনা দেন।
যে কারণে মোকাকে মোকাবিলার মতো এবারও সরকারের নিয়মিত প্রস্তুতি ছিল। আমরা জানি, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। আট লাখের মতো মানুষকে ৯ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছে; সঙ্গে তাদের গবাদি পশু বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছে। জিআইএস রাডার স্যাটেলাইট তথ্যচিত্র, বুলেটিন ও বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রেরণ করছে।