পাকা আম বাজারে আসা শুরু হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এসব আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশ-অপরিপক্ব আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে বাজারজাত করার কারণে ইতোমধ্যে অনেক আম জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।
আজকাল আর পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করা হয় না। কাঁচা ফল গাছ থেকে পেড়ে রাসায়নিক যৌগ দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো ফল বাজারজাত করা হয়। এ কারণে ভোক্তাদের মধ্যে আম ও অন্যান্য ফল খাওয়া নিয়ে সবসময় চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। বাগান থেকে পাড়ার পর আমে পাঁচবারেরও বেশি রাসায়নিক মেশানো হয় বলে জানা যায়। সত্য কিনা জানি না, অভিযোগ রয়েছে-আম পাকার পর তা যেন পচে না যায়, এজন্য নিয়মিত স্প্রে করা হয় ফরমালিন। রাতে আমের দোকান বন্ধ করার আগে ফরমালিন স্প্রে করে রাখা হয়। ভোরে ওই আমের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হলেও ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে না। তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বাইড মেশানো আম উচ্চ তাপমাত্রায় রাখা হলে ক্যালসিয়াম সায়ানাইড তৈরি হতে পারে। ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম খাওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। আম বিক্রির এ মৌসুমে সংশয়ে ভুগতে হচ্ছে সবাইকে।
আম ব্যবসায়ীরা বলছেন, পঞ্চাশ কেজি আম পাকাতে আমের খাঁচায় ১০০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড দেওয়া হয়। আম চকচকে করার জন্য এক ধরনের কেমিক্যাল দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা আরও বলেছেন, জলীয়বাষ্পের সংস্পর্শে এসে ক্যালসিয়াম কার্বাইড অ্যাসিটাইলিন গ্যাস উৎপাদান করে। এ গ্যাসের প্রভাবে আম পাকে। আমে যতটুকু ক্যালসিয়াম কার্বাইডের জলীয় দ্রবণ ডুবানো হোক বা দেওয়া হোক না কেন, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আম চাষি দাবি করেন, গাছপাকা আম পরিবহণ করলে খরচ পোষাবে না। গাছপাকা আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়ার সময় তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকার পর বিক্রি করতে আড়তে পাঁচ থেকে সাত দিন রাখার প্রয়োজন হয়। আর সব ফল একসঙ্গে পাকে না। এগুলো নিয়মিত বাছাই করতে খরচ বেশি পড়ে যায়। তাই তারা একসঙ্গে সব ফল পাকাতে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে আম পাকিয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ অপরাধ করে থাকে। বাগানের বিভিন্ন গাছে আম ধাপে ধাপে পাকে। কিন্তু এভাবে ধাপে ধাপে পাকা আম পরিবহণ ও ব্যবসার জন্য সুবিধাজনক নয়। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ আম পাকাতে কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের পরিবহণ খরচ কম হয়। তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারে ফলের রং সুন্দর হয়। ক্রেতাকে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। এছাড়া গাছে মুকুল আশার আগেই বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আম পূর্ণবয়স্ক হয়ে পাকা পর্যন্ত ৫ থেকে ৭ দফায় রাসায়নিক মেশানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে আম বেশি রঙিন, সে আমে যে রাসায়নিক মেশানো হয়েছে এটি নিশ্চিত। তাই হালকা সবুজাভ রয়েছে এমন আধপাকা আম কেনা সবচেয়ে নিরাপদ। বোঁটা কালো ও শুকনা দেখলে আম ও কাঁঠাল কিনবেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা গেলে ২-৩ সপ্তাহ আম রাখা যাবে। সেক্ষেত্রে ফরমালিন ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। এ কাজে বেসরকারি উদ্যোক্তা বা সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নতমানের প্যাকেটে করে আম বাজারজাত করা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের পর আম পাকবে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আম জীবাণুমুক্ত করে প্যাকেটজাত করা যেতে পারে। আমি মনে করি, আমচাষির চাষ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। মুকুল আসার আগে ছত্রাক প্রতিরোধে একবার রাসায়নিক ব্যবহার, মুকুল পড়া বন্ধে এবং আম পরিপুষ্ট করতে ভিটামিনজাতীয় ওষুধ ব্যবহার এবং পোকা দমন করতে সীমিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বাগানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
মুকুল আসার পরে এবং ফোটার আগে একবার স্প্রে এবং আরেকবার আম মটরদানার সমান হলে কীটনাশক দেওয়া যেতে পারে। দেশের মানুষ দাগবিহীন, পরিষ্কার ও সুন্দর আম কিনতে চায় না। কারণ তারা মনে করে পরিষ্কার ও সুন্দর আমে রাসায়নিক পদার্থ থাকে।
প্রবাদ আছে-‘প্রতিদিন একটি করে আপেল খাবেন, ডাক্তারের কাছে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।’ কথাটি আজকাল আর সত্য বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। শুধু আপেল নয়, আরও বহু রকম সুস্বাদু ফল খেয়ে কোনো কোনো সময় আমাদের ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হতে পারে। বিশেষ করে পাকা টমেটো, আম, কলা, পেঁপে, আনারসের মতো উপাদেয় ফল যদি ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার্য একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের নাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ইথ্রেল বা ইথেফোন ব্যবহার করেও কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো যায়। তবে ইথ্রেল বা ইথেফোন ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান নয়। কারণ, ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য বিপজ্জনক দুটি বিষাক্ত উপাদানের মিশ্রণ থাকে অল্প পরিমাণে। উপাদানগুলো হলো-বহুল পরিচিত আর্সেনিক ও ফসফরাস। অসাবধানতার কারণে এবং ভুল পদ্ধতিতে উচ্চমাত্রায় ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হলে এ ফল আর্সেনিক ও ফসফরাস দ্বারা দূষিত হয়ে পড়তে পারে এবং বিষাক্ত উপাদান দুটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যহানি ছাড়াও জীবন বিপন্ন হতে পারে। আর্সেনিক ও ফসফরাস দূষণের ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে বমি হওয়া, ডায়রিয়া, পেট ও বুকে জ্বালাপোড়া করা, তৃষ্ণা পাওয়া, সাধারণ দুর্বলতা, কথা বলতে বা কিছু গিলতে অসুবিধা হওয়া। এ ছাড়া হাত-পা অবশ হওয়া, শরীরের চামড়া ঠান্ডা ও ভিজে যাওয়া এবং রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো উপসর্গগুলোও দেখা দিতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড অত্যন্ত ক্রিয়াশীল দ্রব্য বলে ভেজা হাতে ধরলে হাতে ফোসকা পড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষাক্ততার উপসর্গগুলো আগেভাগে দৃশ্যমান হয় বলে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে আর্সেনিক ও ফসফরাস বিষাক্ততার কারণে জীবন বিপন্ন হতে পারে।