আমানতকারীদের ঠকিয়ে ব্যাংক মালিকরা যে আনন্দ পান তা বোঝা যায়। তারা তাদের বশংবদ নির্বাহীদের দিয়ে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ আদায় করেন ভালোই। কিন্তু তার সুবিধা আমানতকারীদের মালিকরা দেন না। এই এক অবিচার চলছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেক অভিযোগ, আপত্তি, লেখালেখি হয়েছে; কিন্তু ‘ত্রাণকর্তা’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো কিছু করেনি। ফলে অবিচারটি বহু পুরোনো হয়েছে। আগে তো সুদ সব নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। এবং তা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ১৯৯০-এর দশকে সুদ নির্ধারণের দায়িত্ব স্ব স্ব ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হয় বাজারের কথা, ‘মার্কেটের’ কথা। বাজার অর্থনীতির অধীনে সুদের হার নির্ধারিত হবে। আমানত ও ঋণ-উভয়ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে।
শুরু হলো সেই প্রথা। বাজার অর্থনীতির কথা বলা হলো ঠিকই, এর ফল আমানতকারীরা কিন্তু সেভাবে পেল না। মালিকরা তাদের স্বার্থ ঠিকই রক্ষা করল নানাভাবে। আমানতকারীদের ঠকালো। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ ভালো মতোই আদায় করল। সেই সুবিধা তারা কাজে লাগাল ভিন্ন এক খাতে। খারাপ ঋণের বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখতে হয় মুনাফার টাকা থেকে। তারা আমানতকারীদের ঠকালো, ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভালো সুদ আদায় করল। সেই টাকা দিয়ে তারা তাদেরই সৃষ্ট খেলাপি ঋণের (ক্লাসিফায়েড লোন) বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখল। বড় মজার ব্যবসা, যে কারণে সবাই ব্যাংকের মালিক হতে চায়। লাভেই লাভ। ৪০০-৫০০ কোটি টাকা পুঁজি দরকার হলেও ব্যাংক মালিক হওয়ার মতো লোকের অভাব হয় না। এমনকি প্রবাসী একশ্রেণির বাংলাদেশি ধনকুবেরও ব্যাংকের মালিক বনে গেল। ব্যাংক বানিয়ে অনেকে লুট করে দেশত্যাগ করেছেন। তাদের ‘বোর্ড মিটিং’য়ে মাথাপিছু লাগত-ডিনার খরচেই হাজার হাজার টাকা। এসব খবর আমরা কাগজে পড়ি আর অবাক হই, বিস্মিত হই। বিস্মিত হই বাঙালির ‘উন্নতি’ দেখে। এরই মধ্যে চলছে ব্যাংক ব্যবসা। শুধু ‘সুদ’ নয়, ব্যাংক মালিকরা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে নানাভাবে নানা ধরনের চার্জ আদায়ও শুরু করেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে প্রকাশিত যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম ছিল : ‘সিঙ্গেল ডিজিটে শুভঙ্করের ফাঁকি : ব্যাংক ঋণের বিপরীতে ৪৪ ধরনের চার্জ’। এই ৪৪ ধরনের ‘চার্জের’ মধ্যে একমাত্র শুধু আমদানি-রপ্তানিতেই কাটা হচ্ছে ২৯ ধরনের ‘চার্জ’ বা ‘কমিশন’। এছাড়া দেশীয় পর্যায়ে ঋণের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ ধরনের মাশুল গুনতে হয় ঋণগ্রহীতাকে। এ ঘটনা কখনকার? সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একজন খুবই বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে কতটা সফল ছিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন। তিনি আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী নীতি করলেন-‘নয়-ছয়’। আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদ দেওয়া হবে ৬ শতাংশ হারে, আর এর বিপরীতে ঋণ দেওয়া হবে ৯ শতাংশ হারে। ব্যাংকের ‘মার্জিন/স্প্রেড’ থাকবে ৩ শতাংশ। অথচ বাজারে তখন মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের অনেক উপরে। এবং এ ঘটনাটি তিনি করলেন একটি হোটেলে এক মিটিংয়ে বসে। যা করার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, তা করলেন অর্থমন্ত্রী। ‘নয়-ছয়’ সুদনীতির কারণে সঞ্চয় নিরৎসাহিত হলো। আমানতের বাজার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলো। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের বাজারও তছনছ করা হলো। সেই থেকে আমানতের বাজার এখনো টালমাটাল। মূল্যস্ফীতি, মানুষের জীবনধারণের ব্যয়ভার ইত্যাদি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এই যে ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি, তা কিন্তু বাজার অর্থনীতি বা ‘মার্কেট ইকোনমি’র বিরুদ্ধ ধারণা। অথচ সরকারের ঘোষিত ও অনুসৃত নীতি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতির নীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে হলো বিপদ। বিপদে পড়ে গেলাম আমরা ‘ত্রাণকর্তা’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে। তারা ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসাবে বলল, সুদ ধার্য হবে বাজারে। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে। আর তাই ৪৭০ বিলিয়ন ডলারের একটা অর্থনীতিকে মাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য কঠিন কঠিন বদহজমি সব শর্ত মানতে হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পাগলপ্রায় ওইসব শর্ত পালন করতে গিয়ে। অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে। এ এক যুদ্ধ। স্ববিরোধী সব টার্গেট আইএমএফের। বাকিতে খেলে যেমন দোকানিদের কথামতো পণ্য কিনতে হয়, তেমনি হয়েছে আমাদের অবস্থা। নড়াচড়ার জায়গা নেই!