শিশু বয়সে লেটোর দল দিয়ে নজরুলের সংগীত জীবন শুরু হয়। ওই অল্পবয়সেই তার সংগীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ছেলেবেলায় তার বিচিত্র বিষয়ে গান রচনায় হাতেখড়ি হয়। ওই সময়ে পালাগান রচনা করতে গিয়ে নজরুল হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেছেন। সব ধরনের পালা গানে মুসলিম প্রচলিত ইতিকথা, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি উভয়ের প্রভাব রয়েছে।
অল্প বয়সে পিতাকে হারাবার পর নজরুলের জীবন অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যায়। ১৯১৭ সালে নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য করাচি যান। সেইখানে নজরুলের নানান ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। এখানে ফারসি ভাষা ও গজলের সাথে তার পরিচয় ঘটে।
এই বিষয়ে তার গভীর আগ্রহের ফলে তিনি এক পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে ফারসি ও গজল বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। ফারসি গজল মূলত ঈশ্বর প্রেমের গান। পরে এতে নরনারীর প্রেমও বিষয়বস্তু হয়, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের ফারসি ও উর্দু গজলের ক্ষেত্রে এই কথা সত্য।
আমার মতে নজরুলের গজল উর্দু গজলের রসই গ্রহণ করেছে বেশি, তবে কিছু কিছু গজলে আমরা পারস্যের সুফি গজলের প্রভাব লক্ষ্য করি। এই ধরনের একটি গজল—
‘তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন জানাও জানাও বেদিল প্রিয়ায়।ওগো বিজয়ী নিখিল হৃদয় কর কর জয় মোহন মায়ায়।।’
এইরকম আরেকটি গান—
‘রে অবোধ! শূন্য শুধু শূন্য ধূলো মাটির ধরা।
শূন্য ঐ অসীম আকাশ রংবেরং-এর খিলান-করা।।’
এই দুটি গানই পারস্যের সুফি দর্শনের ওপর ভিত্তি করে রচিত গজল, কিন্তু আমরা এতে হিন্দুস্থানি রাগ-রাগিণীর প্রভাব লক্ষ্য করি। প্রথম গানটি ভৈরবী রাগে রচিত, দ্বিতীয়টি বেহাগ রাগে রচিত। এই রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ নজরুলের গজলকে পারস্যের ঐশী বাণীসম্বলিত গজল থেকে আলাদা করেছে, বিশিষ্ট করে তুলেছে।
পাশাপাশি নজরুলের অনেক গজলে আমরা নর-নারীর প্রেম বিষয়বস্তু হিসেবে লক্ষ্য করি। এখানে উর্দু গজলের প্রভাবই বেশি। যেমন—‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি-জলমলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল।।’