বাংলাদেশ ব্যাংক ৮ মে থেকে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এর ফল একদিনের ব্যবধানেই প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিপরীতে ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, নতুন এ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার এ অবমূল্যায়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যদি সঠিক না হয়, তাহলে অর্থনীতিতে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। কৃত্রিমভাবে স্থানীয় মুদ্রাকে অবমূল্যায়িত করে রাখা বা অতিমূল্যায়িত করা কোনোটাই কাম্য নয়। বাংলাদেশি টাকার মান এতদিন প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি ছিল। স্থানীয় মুদ্রা যদি অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়, তাহলে আমদানিকারকরা উপকৃত হয়ে থাকেন। তারা তুলনামূলক কম স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে বিদেশি মুদ্রা ক্রয় করতে পারেন। এতে আমদানি ব্যয় কম হয়। আর স্থানীয় মুদ্রাকে যদি অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। কারণ তারা একই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে স্থানীয় মুদ্রা আগের চেয়ে বেশি পাবেন। তাই আমদানিকারকরা সাধারণত চান স্থানীয় মুদ্রার যাতে অবমূল্যায়ন না ঘটে। আর পণ্য রপ্তানিকারকরা চান স্থানীয় মুদ্রার যাতে অবমূল্যায়ন ঘটে। কিন্তু স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার এমনভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে টাকার প্রকৃত মূল্য প্রতিভাত হয়। স্থানীয় মুদ্রার প্রকৃত বিনিময় হার নির্ধারিত হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়।
সাধারণত তিনভাবে কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্থির বিনিময় হার। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার একটি বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকগুলো সেই বিনিময় হার অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। এছাড়া মধ্যবর্তী একটি পদ্ধতি আছে, যাকে ‘ক্রলিং পেগ’ বলা হয়। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের একটি হার নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকগুলো সেই নির্ধারিত বিনিময় হারের কিছু কম বা বেশি মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করতে পারে। তবে ব্যাংক ইচ্ছা করলেই অস্বাভাবিক বেশি অথবা কমে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে একদিনের ব্যবধানেই ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ৭ টাকা কমে যাওয়া বাজারে ডলারের জোগান ও চাহিদার সঙ্গে অনেকটাই সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১১৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একে অনেকটাই বাজারভিত্তিক বিনিময় হার অর্থাৎ রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট বলা যেতে পারে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক, যা অর্থনীতির জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে। আমাদের বৈদেশিক খাতে যে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, তা নিরসনে এ উদ্যোগ কিছুটা হলেও কাজে আসবে। স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে অনেকদিন ধরেই অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছিল। ভবিষ্যতে টাকা যাতে অতিমূল্যায়িত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে এ মুহূর্তে যদি ডলারের বিনিময় হার সরাসরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে টাকার ব্যাপক দরপতন ঘটত, যা অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হতো না। তাই ক্রলিং পেগ পদ্ধতির মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হার ধীরে ধীরে নমনীয় করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাকে একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) অনেকদিন ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। সম্প্রতি আইএমএফের কর্মকর্তা পর্যায়ের যে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে যায়, তারাও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে অর্থনীতিতে তেমন একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঘটবে না। এভাবে এক সময় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা সম্ভব হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার চাহিদা ও জোগানের সঙ্গে সংগতি রেখে নির্ধারণ করা গেলে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির আশঙ্কা দূর হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষিত হবে।