১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে একটা আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আজ পর্যন্ত প্রচেষ্টারত এ দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু আজও সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। স্বাধীনতার সংগ্রামে ঘৃতাগ্নি হিসেবে ব্যবহৃত ‘সোনার বাংলা শ্মশান হলো কেন’ পোস্টারটি আজকের দিনে হয়তো অনেকের কাছে মূল্যহীন মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করি, এই পোস্টার এখনো জনগণের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সাহস ও শক্তি জোগাবে। বিশ্বাস করি, ‘আমরা করব জয়’ বলে মানুষ জোটবদ্ধ হবে, নিজেরা অধিকার সচেতন হয়ে দেশের রাজনীতিকদের জনকল্যাণে নিবেদিত হতে বাধ্য করবে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মৌখিক পর্যায়ে থাকবে না।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজ উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার প্রতিযোগিতায় ছুটে চলেছে। জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, বাজেটের কলেবর বেড়েছে, জীবন মানের উন্নতি হয়েছে, একটার পর একটা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রেষণে বিরাট শিল্পের মালিক তৈরি হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু তারপরও সাধারণ জনগণের চাহিদার শেষ হতে চায় না, আসলে তারা জানে না, কিসে তাদের মঙ্গল হবে, কল্যাণ হবে। নেতারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অংশ হিসেবে জনগণের কল্যাণ চিহ্নিত করে সেই পথে জনগণের সমস্যা সমাধানে প্রজ্ঞা আর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে শুধু পরিচিতই করেননি, অনেক ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে স্থান করে দিয়েছেন। দেশের নেতৃত্ব আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় রাখছে। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রাপ্তি হিসাব করলে তা নেহাত কম বলা যাবে না।
দেশে উন্নয়ন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিদ্যুতের খাম্বা উন্নয়ন থেকে উৎপাদন—সবখানেই মহাযজ্ঞ চলছে। আজ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এমন জায়গায় নিয়ে চলেছে, যা ব্যবহার করার জায়গা তৈরি করার সময় পর্যন্ত পাচ্ছে না। ফলে জনগণ এত উৎপাদনের পরও লোডশেডিং থেকে মুক্ত হতে পারল না। সারা দেশে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কাজ চলমান। এ কাজ দশকের পর দশক ধরে চলায় জনগণ ভুলেই গেছে কবে তারা পিচঢালা মসৃণ পথে চলাচল করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রতিটি উৎসবের সময় মন্ত্রী মহোদয় নির্দেশ দেন, আগামী তিন বা সাত দিনের মধ্যে দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক মেরামত শেষ করতে হবে, উৎসবযাত্রা যেন নিরাপদ হয়। যেহেতু দেশে সব প্রকল্প আড়ম্বরের সঙ্গে শুরু হয়, কিন্তু কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না, ফলে মন্ত্রী উৎসবের আগে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে ঘোষণা দিয়ে দেন এবং উৎসব শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানান যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে বলে। মন্ত্রীর এটুকু দায়িত্ব পালনেই জনগণ খুশিতে গদগদ। কারণ বছরের পর বছর ধরে এ রকম বাণী শুনে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন তো সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে, একনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হচ্ছে তা দেখার জন্য।
এ বছর ছিল জাতীয় নির্বাচনের বছর। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে সারা দেশ সফরে যেতে হয়। তবে এসব সফরে তিনি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরবরাহ করা তালিকা পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেছেন বলেই মনে হয়। কারণ স্থানীয় নেতা-কর্মীরা উন্নয়নের যে বিশাল তালিকা তৈরি করে থাকে, তাতে এমন সব প্রকল্পের নাম থাকে যার সিংহভাগ ধারাবাহিক উন্নয়নের অংশ মাত্র। কিন্তু তালিকা লম্বা করতে এসব করা হয়ে থাকে। আর ক্ষমতার বলয় তো মেগা প্রকল্পে অনেক বেশি আগ্রহী, এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট প্রকল্পে কারও কোনো আগ্রহ নেই। ফলে ধারাবাহিক ছোট ছোট উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করেই তালিকা লম্বা করতে হয়।