রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের লেখা ‘How much land does a man require’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, লেখক কতটা সুন্দরভাবে একজন লোভী মানুষের চরিত্র সেখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পৃথিবীর লোভাতুর মানুষকে জীবনের হিসাব নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার জন্য একজন কৃষকের জমির প্রতি লোভকে কেন্দ্র করে গল্পটি রচনা করলেও মূলত তিনি সব ধরনের লোভ-লালসা থেকে মানবসমাজকে মুক্ত থাকার জন্য গল্পটিতে অতি মূল্যবান একটি মেসেজ দিয়েছেন।
কৃষক প্যাহোম একজন অত্যন্ত লোভী ব্যক্তি ছিল। কম দামে যেখানেই ভালো জমি পাওয়া যেত, সেখানেই সে জমি কিনতে ছুটে যেত এবং সেসব জমি ভোগদখল করে মুনাফা লুটত। আর এভাবে সে সামান্য একজন কৃষক থেকে জমিদারে পরিণত হয়ে ভূসম্পত্তিসহ প্রচুর গরু, ঘোড়া ইত্যাদি গবাদি পশুরও মালিক বনে গেল।
এ অবস্থায় একবার সে শুনতে পেল, পাহাড়ের পাদদেশে একদল মানুষের বসবাস, যারা বস্কির বলে পরিচিত, সেখানে খুব সুন্দর সুন্দর জমি কম দামে পাওয়া যায়। খবরটি শুনে প্যাহোম কালবিলম্ব না করে চাকরটিকে সঙ্গে নিয়ে সেদিকে ছুটল। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখল, চারদিকে সবুজে ঢাকা মাঠের পর মাঠ। এলাকার লোকের সঙ্গে কথা বলে সে জানতে পারল, জমি কিনতে হলে তাদের সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিয়ালের চামড়ার টুপি পরা সর্দার সেখানে উপস্থিত হলে তারা পাহাড়ের উপরে উঠে দরদাম ঠিক করার সময় সর্দার বললেন, ‘আমরা দিন হিসাবে জমি বিক্রি করি, এক হাজার রুবেলের বিনিময়ে একদিনের ভেতরে তুমি পায়ে চলে যতদূর ঘুরে আসতে পারবে, ততখানি জমি তোমার হবে, তবে মনে রেখ সূর্যাস্তের আগে তুমি এখানে ফেরত না আসতে পারলে কিন্তু তোমার টাকা মার যাবে।’
সর্দারের কথায় কৃষক প্যাহোমের মন আনন্দে ভরে উঠল। সে ভাবল, সারাদিনে অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরে সহজেই প্রচুর জমির মালিক হয়ে যাবে! তাড়াতাড়ি সে সর্দারের টুপিতে এক হাজার রুবেল রেখে বলল, সারাদিনে আমি কতদূর বা কোন পর্যন্ত ঘুরে এলাম, কীভাবে তার প্রমাণ থাকবে? সর্দার বললেন, তুমি একটি কোদাল সঙ্গে নিয়ে যেও, যা দিয়ে তুমি যেখানে যেখানে যাবে, সেসব স্থানে কোপ দিয়ে চিহ্নিত করে আসবে। প্যাহোম ঘাড় নেড়ে বলল, তাহলে কাল সকালেই সে হাঁটা শুরু করবে। এ অবস্থায় সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে লাগল সারাদিন সে বহুদূর অবধি ঘুরে আসবে, একদিনে সহজেই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মাইল ঘুরে আসতে পারবে, কারণ দিনগুলোও খুব লম্বা, কত জমির মালিকই না সে হবে। জমিগুলো দখলের পর তাকে আরও অনেক গরু আর ঘোড়া কিনতে হবে, বহু লোকও খাটাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত অনিদ্রায় কেটে যাওয়ায় সূর্যোদয়ের আগেই সে একটি কোদালসহ চাকরটিকে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল এবং পূর্বাকাশ লাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বেরিয়ে পড়ল।
চারদিকেই কেবল সবুজ আর সবুজ, কোন দিকে যাবে ঠিকমতো তা ঠাহর করতে না পেরে সে স্থির করল, যেদিকে সূর্য টকটকে লাল হয়ে উঠছে, সেদিকেই যাবে। প্যাহোম চলা শুরু করল এবং প্রথমে খুব জোরেও না, আবার আস্তেও না এভাবে চলা শুরু করল। চলার পথে প্রতি হাজার গজ অন্তর সে একটি করে গর্ত করে রেখে যেতে থাকল, যাতে করে তার জমির সীমানা নির্ধারিত হয়। এভাবে কিছুক্ষণ পর সে অনুমান করল, তিন মাইল এসেছে। তখন রোদের তেজ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় গায়ের জামা খুলে সে কাঁধে রাখল। কিছুক্ষণ চলার পর রোদ আরও বেড়ে গেলে সে সঙ্গে আনা কিছু খাবার খেয়ে নিল। তারপর এখনো অনেক সময় আছে ভেবে আবার সামনের দিকে অগ্রসর হলো। চলতে চলতে ভাবল, আরও তিন মাইল সামনে গিয়ে সে বাম দিকে ঘুরবে। এভাবে যতই এগোতে থাকল, ততই ভালো জমি তার চোখে পড়ল। ফলে তিন মাইল পার হয়ে গেলেও সে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলল, কারণ এসব ভালো জমি ফেলে আসা যায় না। এভাবে ক্রমাগত সে সামনের দিকে এগাতে থাকল আর ভাবল, সারা জীবন আর কোনো চিন্তা করতে হবে না, আজ সারাদিনে যতটা পারি জমি দখলে নিয়ে বাকি জীবন সুখ-শান্তি এবং অত্যন্ত আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেব। এসব ভাবতে ভাবতে সে কেবলই দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চলল এবং কোদাল দিয়ে জমি চিহ্নিত করতে থাকল। অতঃপর এক সময় সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ল। প্যাহোম ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সূর্যটাকে দেখে নিয়ে ভাবল আর বেশিক্ষণ সময় নেই, এ অল্প সময়ের মধ্যেই যতটা পারি বেশি জমি দখলে নিতে হবে। এ অবস্থায় সে আরও দ্রুত পা চালাতে থাকল এবং আরও কয়েক মাইল জমি কোদালের কোপে চিহ্নিত করে ফেলল। তারপর সে পেছনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, সূর্যের আলো পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। কিন্তু তারপরও সে লোভ সামলাতে না পেরে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে আরও কিছু জমি কোদাল দ্বারা চিহ্নিত করে ফলল। তখন সে ভীষণ ক্লান্ত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই, চারদিকে কেমন আবছা হয়ে আসছে। এতক্ষণ জমি দখলের নেশায় মেতে থাকলেও এক্ষণে তার বস্কির সর্দারের শর্তের কথা মনে পড়ে গেল। সূর্যাস্তের আগে পাহাড়ে ফিরতে না পারলে জমিও যাবে, টাকাও যাবে কথাটি মনে পড়তেই সে পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করল। সে খুব দ্রুত চলতে লাগল এবং কয়েক মাইল এগোনোর পর দেখল, তাকে কমপক্ষে আরও দশ-বারো মাইল যেতে হবে। এদিকে সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে, একটু পরেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবে। এসব কথা ভেবে অতি দ্রুত পা চালাতে থাকায় প্যাহোমের চলতে অনেক কষ্ট হতে লাগল, ভয়ানক গরমে সে অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়ল। তার পা কেটে চিরে গিয়েছে, আর চলতে পারছে না। বিশ্রাম করতে অত্যন্ত ইচ্ছা হলো, কিন্তু সূর্যান্তের আগে তার পৌঁছানো চাই-ই-চাই!