পরিবেশদূষণে বছরে এ দেশে প্রায় পৌনে ৩ লাখ লোক মরছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঘরের ভেতরের ও বাইরের দূষণে সবচেয়ে বেশি লোক মরছে, যার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ। অন্যান্য দূষণের মধ্যে রয়েছে সুপেয় পানির ঘাটতি এবং পয়োনিষ্কাশনজনিত দূষণে মৃত্যু, আর্সেনিক ও সিসার দূষণে মৃত্যু। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনে এ দেশে সব সময় নানা রকম দুর্যোগ লেগে আছে। তার ওপর নানা রকম পরিবেশদূষণে এভাবে এত প্রাণ হারানো অত্যন্ত দুঃখজনক।
কিছুদিন আগে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০২৩’ প্রতিবেদনের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সমস্যা যে নেই, তা আমরা কখনোই বলব না। আমরা স্বীকার করছি, অবশ্যই পরিবেশের নানা সমস্যা আছে। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ এতটা কি না, তা আমাদের নিজেদের মূল্যায়ন করতে হবে।
আমাদের অর্থের সমস্যা আছে, দক্ষতার সমস্যা আছে। পরিবেশগত সমস্যা নিরসনে অর্থ ও দক্ষতা দুটোই দরকার।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশে জলবায়ু খাতে যে অর্থায়ন হয়েছে, তার ৪০ শতাংশ এসেছে ঋণ হিসেবে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বড় বড় দেশ যারা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, তাদের কোনো দায় নেই, কিন্তু দায়টা আমাদের নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের হয় অনুদান নিতে হচ্ছে অথবা সহজ শর্তে ঋণ নিতে হচ্ছে।’
তার মানে, পরিবেশদূষণ কমাতে আমাদের জরুরিভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো নিতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থের জোগান সুনিশ্চিত ও সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই দূষণ হ্রাসে নেওয়া পরিকল্পনায় কাটছাঁট করতে হয়। তা ছাড়া পরিবেশদূষণ রোধে যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, সেগুলোও অনেক সময় দক্ষতার অভাবে আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি না। এতে পরিবেশদূষণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে আসলে কমে না। তাই পরিবেশদূষণ রোধে একদিকে যেমন দরকার দক্ষতার, সঙ্গে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ, অন্যদিকে দরকার সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন। এরপর দরকার হয় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। অর্থের উৎস হিসেবে সরকারের রাজস্ব তহবিল থেকে প্রতিবছরই এই খাতে কিছু অর্থের সংস্থান রাখা হয়। তবে তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় প্রতিবছরই সরকারকে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ নিতে হয়, যা উন্নয়ন বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
সে জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন পরিবেশ দূষণকারীদের ওপর পরিবেশ কর বা ইকোট্যাক্স ও শুল্ক আরোপ করে পরিবেশ সংরক্ষণের তহবিল গঠন করা হয়। পরিবেশ দূষণকারীদের পাপমোচনের রাস্তা হলো পরিবেশ কর বা শুল্ক প্রদান করে দায়মুক্তি। এসব তহবিল পরিবেশ সংরক্ষণে খরচ করা হয়, তখন অনুদান বা ঋণ গ্রহণের কোনো দরকার পড়ে না।
পৃথিবীর অনেক দেশেই পরিবেশ সংরক্ষণে পরিবেশদূষণের মতো গর্হিত কাজ থেকে দূষণকারীদের নিরুৎসাহিত ও নিবৃত্ত করার জন্য পরিবেশ কর ও শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এ-সম্পর্কিত গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা যায়। আয়ারল্যান্ডে ২০০১ সালের মার্চে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। প্লাস্টিক পণ্য বিক্রির স্থানে শুল্ক আরোপ করা হয় ০.১৫ ইউরো, ২০০৭ সালে তা নির্ধারণ করা হয় ০.২২ ইউরো। এর মানে, খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে কেউ একটি প্লাস্টিক ব্যাগ কিনলে তাঁকে শুল্ক হিসেবে সেই ব্যাগের দামের সঙ্গে অতিরিক্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয় ০.২২ ইউরো। এতে সে দেশে সে সময় থেকে ২০১৫ সালে এসে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ০.১৩ শতাংশ এবং এর দ্বারা সে দেশে সেই ১২ বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউরো তহবিল গঠিত হয়।