সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফরকালে আবার তিস্তা প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। তাঁর সফরের আগে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে তিস্তা নিয়ে চীনের প্রকল্প ভারতের জন্য উদ্বেগের। কারণ, এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর কাছাকাছি। এই প্রকল্পের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে আরও লক্ষ করা হয় যে ভারত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে; যা নদী-সম্পর্কিত কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঢাকার অধৈর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। (যুগান্তর, ৮ মে ২০২৪)
অবস্থাদৃষ্টে এমনটা প্রতীয়মান হচ্ছে, তিস্তাবিষয়ক চীনা প্রকল্প থেকে বাংলাদেশকে বিরত করাই সচিবের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। বস্তুত সফরকালে ভারতের সচিব ভারত কর্তৃক তিস্তা প্রকল্পের অর্থায়নের প্রস্তাব করেছেন। একে বলা যেতে পারে ‘চীনকে বাদ দিয়ে চীনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের’ প্রস্তাব।
তিস্তা বিষয়ে ‘পাওয়ার-চায়না’ কর্তৃক প্রণীত একটি পরিকল্পনার কথা ২০১৬ সাল থেকে শোনা যাচ্ছিল। সে বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের আগে ‘পাওয়ার-চায়না’ বাংলাদেশের সব বৃহৎ নদ-নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘নদ-নদীর স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি’ নামে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে।
সূচনায় এই কর্মসূচি যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুরোধক্রমে এতে তিস্তা নদীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ‘পাওয়ার-চায়না’ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বাজেটের ‘তিস্তা নদী সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ প্রণয়ন করে।
প্রথম থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কড়া ‘গোপনীয়তার নীতি’ গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার এ ধরনের প্রকল্পের ঋণ নেয় এবং কোনো না কোনোভাবে জনগণকেই এই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তাহলে জনগণ কেন এই প্রকল্প সম্পর্কে জানতে এবং মতামত প্রকাশ করতে পারবে না, তা বোধগম্য নয়।
ব্যাপারটি আরও পরিহাসমূলক এ কারণে যে ‘পাওয়ার-চায়না’ এই প্রকল্প নিয়ে ভিডিও তৈরি করেছে এবং ইউটিউবের মাধ্যমে তা বিশ্বব্যাপী প্রচার করছে। ফলে বাংলাদেশের জনগণ নিজের দেশের একটি প্রকল্প সম্পর্কে নিজেদের সরকারের কাছ থেকে জানার পরিবর্তে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে জানতে পারছে।
এরপরও বাংলাদেশের অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকেরা এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছু তথ্য, যেমন প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) সংগ্রহ করতে পেরেছেন। প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব এবং ‘পাওয়ার-চায়না’র ভিডিওসহ অন্যান্য সূত্রের তথ্যের আলোকে এখন এই প্রকল্প সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা আমরা পেয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিষয়ক অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান এসব তথ্যের ভিত্তিতে কিছু গবেষণা করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার আলোকে সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি গ্রন্থে আমি তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরিবেশন করেছি। বই দুটি হলো বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বর্তমান ধারার সংকট এবং বিকল্প পথের প্রস্তাব (২০২৩) ও ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার (২০২২)। বই দুটিতে তিস্তা অববাহিকার উন্নয়নের জন্য বিকল্প কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে।